গোয়া, ভারতের পশ্চিম দিকে আরব সাগরের তীরে অবস্থিত এই ছোট্ট রাজ্যটি পৃথিবী বিখ্যাত। গোয়া শুধু একটা ঘুরতে যাওয়ার জায়গা না, স্বাধীনতার অন্য আরেক নাম। গোয়া হল সেই স্বাধীনতা যা আপনাকে নিত্যকর্ম থেকে এক লাফে নিয়ে আসতে পারে অসীমের সামনে। অসীম যা নাকি অতুল মনির সন্ধানে, সমুদ্রের মাঝে গিয়ে ঝাঁপ দেয় এক মারিয়ানা খাতে। আচ্ছা না হয় মানলাম মারিয়ানা খাত অনেক দূরের কথা, আরব সমুদ্রের কোন খাত ই বটে।

গোয়া বেড়াতে যাবেন ভাবছেন? এখানে আরও অনেক দরকারি তথ্য পাবেন!


সপ্তাহের শেষে গোয়ার আশেপাশের বড় শহর গুলি, এই যেমন ধরুন বোম্বে বা ব্যাঙ্গালোর, যেখানে একবিংশ শতাব্দীর মিলেনিয়াল ভারতীয়দের হিপহপ কর্মক্ষেত্র, সেখান থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে ৬৬ ধরে বেরিয়ে আসে অনেকগুলি চারচাকা। আর যদি সেই সপ্তাহ শেষের দুদিনের ছুটির সাথে আর একটা ছুটি যোগ করে নেয়া যায় তাহলে তো সোনায় সোহাগা।

তিনদিন ধরে সমুদ্রের ধারে নুনমাখা জলে চান আর সুজিতে ডোবানো পমফ্রেট ভাজা- এর আরেক নাম জীবন। হ্যাঁ তার সাথে অবশ্যই গোয়ার বিখ্যাত বিয়ার বোতল একটি চেয়ে নেবেন। আপনি যদি একটু সাহসী হোন তাহলে বিয়ার ছেড়ে গোয়ার নিজস্ব জিআই চিহ্নিত দেশী মদ ফেনী পান করে দেখতে পারেন। কাজু পচিয়ে তৈরি হয় ফেনী। ৫০০ গ্রাম বোতলের দাম মোটামুটি ২০০ টাকা থেকে শুরু। নিউটন নামে সুপার মার্কেটে আসল জিনিস বিক্রি হয়।

Goa travel blog

রাতের নিওন আলয় ব্যাংকক এক ভয়ানক মায়াবি শহর।

গোয়ার তুমুল জনপ্রিয়তার জন্য, ইন্ডিয়ান রেলওয়ের কৃতিত্ব কিছু কম নয়। মারগাও আর ভাস্কোডাগামা এই দুটি বড় স্টেশন ভারতের সমস্ত প্রান্তের সাথে গোয়ার সরাসরি যোগাযোগ তৈরি করেছে। ব্যাঙ্গালোর থেকে তো গোয়া যাওয়ার জন্য আমার সবথেকে প্রিয় উপায় হল রাতের ট্রেন। ধীরে ধীরে সেই ট্রেন পশ্চিমঘাট পর্বতের গা বেয়ে উঠে যায় এক মেঘমালাপুর। মাঝে মাঝে, বিশেষত বৃষ্টির সময়, পশ্চিমঘাট পর্বতকে দেখে মনে হয় দার্জিলিংয়ের হারিয়ে যাওয়া ভাই। ঘনসবুজ গাছ যার দিকে তাকালেও নাকে আসে বৃষ্টির গন্ধ, তার মধ্যে খেলা করে মেঘ। মাঝে একবার হঠাৎ করে দেখা দেয় দুধসাগর ঝরনা। বিশাল সেই ঝরনা বর্ষাকালে বিরাট আকার ধারণ করে।

বর্ষা না থাকলে একদিন চলে আসুন না সাউথ গোয়া। সারাদিন ধরে ট্রেকিং করে উঠে চলুন দুধসাগর ঝরনার প্রান্তে। সাঁতারে ফটো হলে ঝাঁপ দিয়ে দিন প্রকৃতির কোলে তৈরি সুন্দর জলাধার গুলিতে।

আর যদি সময় কম থাকে তাহলে একটা প্লেনের টিকিট কেটে ফেলুন ডাবোলিম এয়ারপোর্টের জন্য। এটি একটি আর্মি এয়ারপোর্ট। ছবি তোলা এখানে নিষিদ্ধ। ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট আসে না এখানে। তবে হ্যা, আপনি যদি রাশিয়া থেকে চার্টার্ড প্লেন নিয়ে আসতে চান, ডাবোলিমের দরজা যা আপনার জন্য খোলা। এয়ারপোর্ট এর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে কদম্ব বাস। এসি বাস। ১০০ টাকায় পৌঁছে দেবে পানাজি বা ক্যালাঙ্গুটে। সাথে যদি অনেক বেশি পোটলা থাকে আর অনেকগুলি বন্ধু, তাহলে ২০0০ টাকা দিয়ে একটি গাড়িও বুক করে নিতে পারেন।

এখানে ওলা বা উবার চলে না, তবে গোয়ামাইলস অ্যাপটি ডাউনলোড করে দেখতে পারেন। উবারের মত এত সুন্দর সার্ভিস নয় তবে সকাল বিকেলে গাড়ি পাওয়া সম্ভব। নেট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে আগে থেকেই টাকা দিয়ে দিতে পারবেন।

যাই হোক আজকে আমি গোয়ার গল্প বলতে এসেছি। গোয়া আমি গেছি প্রায় ছ-বার। ছুটে বেড়িয়েছি গোয়ার উত্তর থেকে দক্ষিণে সবকটি সমুদ্র সৈকতে। কিন্তু শুধু সমুদ্র সৈকত না, গোয়ার পাতায় পাতায় লেখা আছে সাড়ে চারশ বছর পুরনো পর্তুগিজ ঐতিহ্যের বিভিন্ন গল্প। মান্ডবী নদীর উপরে যে দ্বীপগুলি অবস্থিত তার গল্প তো প্রায় অজানা। কিছুদিন আমি থেকে এসেছি এরকমই একটি দ্বীপ, দীভর নামে।

Goa Travel Blog

ফন্টেনহাস পাড়া

গোয়ার রাজধানীর নাম হল পানাজি, পানজিম বলে স্থানীয় লোকেরা উচ্চারণ করে থাকেন। আপনি যদি কর্মসূত্রে গোয়া বেড়াতে যান বেশিরভাগ সময় আপনার রাতের আস্তানা হবে পানজিমেই। এখানে থাকাকালীন, ঐতিহ্যপূর্ণ রংবেরং ফন্টেনহাস পাড়াতে লাগিয়ে আসুন এক চক্কর চট করে। মনে হবে আপনি চলে এসেছেন পর্তুগালের কোন নাম না জানা গ্রামে।

এখানে, প্রতিটি বাড়ির গায়ে রামধনুর সাত রং। স্থানীয় লোকেরা এখানে শান্তিতে বসবাস করতেন কিছু বছর আগে অব্দি। কিন্তু ইনস্টাগ্রাম পাগল ফটোগ্রাফারদের যাতায়াত শুরু হওয়ার পর থেকে, ফন্টেনাসের চেহারা বদলে গেছে। অনেকগুলি সুন্দর ক্যাফে তৈরি হয়েছে। বোম্বে কফি রোস্টার্স আর গীতাঞ্জলি গ্যালারি, এ দুটি আমার খুব প্রিয়। এখানে যদি আপনি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিশেষ কিছু খাবার খেতে চান, একবার চট করে সোল শেফ গোয়াতে ঢু্৺ মেরে আসুন।

Goa culture

ভেলহা গোয়া

পানাজি থেকে আধ ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত ভেলহা গোয়া। ভেলহা কথাটি একটি পর্তুগিজ শব্দ, অর্থ পুরাতন। পুরানো গোয়া একটি ঐতিহাসিক জায়গা। অসংখ্য পুরানো চার্চ, সরু গলি, পুরানো বাড়ি, কুনবি শাড়ি পরিহিতা গোয়ান রমণী, সব মিলিয়ে ৫০০ বছরের ইতিহাস এখানে সময় নামক এক শিল্পীর চর্চিত তুলির টানে মায়াবী রূপ পেয়েছে।

পর্তুগিজ শাসন কালীন, এই ভেলহা গোয়া ইউরোপকে নিয়ে এসেছিল ভারতের দোরগোড়ায়। সঙ্গে অসংখ্য খৃষ্টান মিশনারী, যারা পরবর্তীকালে ভারতের বিভিন্ন উপজাতি বেল্টে যীশু খ্রীষ্টের বাণী প্রচার করেছিলেন। ভেলা গোয়ার অন্য নাম ছিল পূর্ব পৃথিবীর রোম। বাসিলিকা অফ বম জেসাস, এই অসহ্য সুন্দর গির্জাটিতে পা রাখলেই আপনি বুঝতে পারবেন রোম কি করে ভারতে পাড়ি দেয়। এটি একটি ইউনেস্কো ঐতিহ্যশালী প্রতিষ্ঠান।

৩০০ বছর আগে প্লেগ মারণ রোগ গাড়ি পুরনো রাজধানীর জীবন কাঠি শুষে নেয়। মানুষজন পাড়ি জমান আশেপাশের বিভিন্ন নদীবক্ষীয় দ্বীপপুঞ্জে। এমনই একটি বিশাল দ্বীপ হলো দিভর। ভারতের একমাত্র আয়ুর্বেদিক ওয়েলনেস রিসোর্ট, মারকিউরি দেভায়া, এখানে অবস্থিত।

পাশের দ্বীপটিতে বিখ্যাত ডক্টর সালিম আলী পাখিরালয়। সবুজে সবুজ এই অঞ্চলটি ঘন ম্যানগ্রোভ জঙ্গল, মান্ডবী নদীর মুখরা, পুরনো পর্তুগিজ কুটির, আর শান্ত কিছু গোয়ার গ্রাম দিয়ে তৈরি। অবশ্য বন্দেরাম উৎসব হওয়া কালীন, দীভরের চেহারা পাল্টে যায়। আর কার্নিভাল, ভারতের মারডি গ্রাস, বা রিও ডি জেনেরিও কার্নিভালের সমকক্ষ একটি উৎসব, যা কিনা পাঞ্জিমের নিজস্ব।

ক্যান্ডোলিম


প্রথমে যখন গোয়া গেছিলাম আমরা ছিলাম ক্যান্ডোলিম নামে একটি জায়গাতে। আমরা ছিলাম ছয়  জন বন্ধু। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সমুদ্রস্নান, খাওয়া-দাওয়া, আবার সমুদ্র স্নান, রাত্রিবেলা ত’র হয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া। বলে লাভ নেই, তখন আমি ট্রাভেল ব্লগিংও করতাম না। অবশ্য, ছবি তুলতাম। আমরা একটি এর এয়ারবিএনবি ভাড়া করে নি। একজন স্থানীয় গোয়া ছেলের ডুপ্ডুপ্লে ফ্ল্যাটটি ।

কাছেই সমুদ্র। বাইকে ১০ মিনিট। হেঁটে গেলে আধঘন্টা। সমুদ্রের ধারেও হোটেল আছে কিন্তু তার দাম বেশি। এই দুইটি মোটামুটি প্রতি জন ৭০০ টাকা হিসেবে পড়েছিল। প্রতি রাতের জন্য। গোয়াতে বাইক ভাড়া করা খুবই সহজ। আমাদের থেকে লাইসেন্স চাইল। আমরা দিয়ে দিলাম। ওনারা লাইসেন্স রেখে আমাদের বাইক দিয়ে দিলেন। বাইকে যতটা তেল ছিল চুক্তি অনুযায়ী সেইটুকু তেল ভরি আমাদের ফেরত দিতে হবে। প্রতিদিন বাইক ভাড়া আড়াইশো টাকা।

Gpa Travel Blog

জীপ বা গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা ভাড়া লাগে দিনের হিসেবে। লাইসেন্স না থাকলে গাড়ি চালাবেন কি করে? আমরা একটা ছবি তুলে নিয়েছিলাম, পুলিশ ধরলে সেই ছবি দেখালি নাকি হয়ে যায়। যদিও পুলিশ আমাদের ধরেনি।

প্রথমবার যদি গোয়া যাচ্ছেন তাহলে আরব সাগরের ধারে পুরো ছুটিটা কাটানো যায়। প্রকৃতি অসহ্য সুন্দর একটি রূপ দেখে বসে আছে, তাকে কাটিয়ে আরো কিছু দেখা অসম্ভব। অন্তত প্রথমবার। কিছুদিন ক্যান্ডোলিম-এর ধারে কাটিয়ে, আমরা শেষ পর্যন্ত একবার উত্তর গোয়ার আরো কিছু বিখ্যাত বীচ দেখতে গেছিলাম।

উত্তর না দক্ষিণ গোয়া?

গোয়াকে মোটামুটি দু’ভাগে ভাগ করা যায় উত্তর, দক্ষিণ। উত্তর ভালো না দক্ষিণ, এই বিতর্ক মোটামুটি ডিম আগে না মুরগি তার সমকক্ষ। দক্ষিণ গোয়া সবকিছু থেকে দূরে, আরো দূরে। স্বাভাবিকভাবে ভিড় এখানে কম। গোয়ার বিখ্যাত অধরা সমুদ্র, না ছোঁয়া জঙ্গল, লুকানো সমুদ্রতট, সব লুকিয়ে আছে দক্ষিণ গোয়াতে। গোয়া বিশেষজ্ঞদের মত এমনই।

তবে উত্তরও কিছু কম নয়। বিশেষত আরামবোল, সত্তরের দশকের হিপীদের বাড়িঘর। আর ঐ উত্তর-দক্ষিণে ঝামেলায় না পড়ে, কিছু লোক (আচ্ছা ঠিক আছে, বেশিরভাগই) বাগা বা ক্যালাঙ্গুটেতে থেকে যান। গোয়ার বিখ্যাত সমুদ্র সৈকত বাগা, ভারতের তথা এশিয়ার অন্যতম বড় সমুদ্রতট। বছরকার দিনে এখানে প্রায় ১০ লাখ মত লোক হয়। প্রচুর থাকার জায়গা প্রচুর খাবার জায়গা। মোটামুটি সস্তা। তবে হ্যাঁ দামি বৈভব শালী হোটেল কিছু কম নেই আশেপাশে। তাজ থেকে শুরু করে লে মেরিডিয়েন, সব।

casa cubo Goa: where to stay in Goa

গোয়া: উত্তরের বীচগুলি

একদিন আমরা বাইক নিয়ে চলে গেছিলাম আরো উত্তরের দিকে। ক্যান্ডোলিম থেকে লাগাতার প্রায় এক ঘন্টার রাস্তা। বাইক কিছুটা সমুদ্রতটের পাশ দিয়ে চলে, কিছুটা চলে নারকেল গাছের বনের মধ্যে। পথের ধারে বসে থাকে সাদা রংয়ের সারস। নাকি ওগুলি বক? উত্তরের পথে যেতে প্রথমে আসে বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট বৃত্ত’স (Britto’s)। এখানকার সামুদ্রিক মাছের সম্ভার অত্যন্ত বিখ্যাত। ভাজা চিংড়ি আর ভাজা স্কুইড, এ দিয়ে আমাদের দুপুরে খাওয়া হয়ে গেছিল। কিং-ফিশ স্টেক, সেটিও খেয়ে দেখতে পারেন, মন্দ নয়।

তারপরে টানা ঘন্টা খানেক বাইক চালিয়ে আমরা পৌঁছলাম গিয়ে মর্জিম বিচ। কিছুটা পাথুরে, কিন্তু অত্যন্ত সুন্দর সমুদ্র। লোকজন অনেক কম। এর থেকে আর একটু সোজা গেলে আপনি পৌঁছে যাবেন আরামবোল। সেখানে বিকেলবেলা হীপি সমুদ্রসৈকতে বাজনা বাজিয়ে থাকেন। তবে আমরা ফিরে এসেছিলাম দক্ষিনে।

vagator beach how to reach

প্রথমে দাঁড়িয়েছিলাম ভাগাটর নাম একটি জায়গায়। যদিও ছোট কিন্তু গোয়ার এই বীচ আমার সবথেকে সুন্দর লাগে। পাহাড় থেকে নিচে নামতে হয়, তবে গিয়ে সমুদ্রে পা ভেজানো যায়। এর পাশেই আছে চাপোরা দুর্গ। দুর্গের ভগ্নাবশেষ বলাই সঠিক। সাধারণত এখানে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা হয়। এখানে আমির খানের বিখ্যাত সিনেমা দিল চাহতা হেয় শুটিং হয়েছিল।

এখান থেকে আমরা ফেরত এসেছিলাম আঞ্জুনা। অঞ্জনা ও পাথরের সমুদ্রতট, একেবারেই সাঁতার কাটার অযোগ্য। তবে এখানে পার্টি হয়, ভোর রাত অব্দি। আর এখানকার রাতের বাজার আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছিল। বিকিনি থেকে শুরু করে গণেশ ঠাকুর আঁকা দেওয়ালে ঝোলানো চাদর, কি না পাওয়া যায় এখানে। একেবারে আমাদের কলকাতা নিউমার্কেট। পরে শুনেছিলাম এই বাজারটি আসলে হীপিদের একটি ঠেক ছিল। হীপিরা কোন জায়গায় বেশিদিন থাকতেন না এবং বেশি জিনিসপত্র অধিকার করে রাখতেন না। ব্যবহার করা, অধিকার করে রাখা: দুটির মধ্যে পার্থক্য আছে! চলে যাওয়ার আগে ওনাদের যা কিছু পার্থিব সম্বল, উনারাই বাজারে বিক্রি করে যেতেন, নবীনদের জন্য।

তখনকার বদ্ধ অর্থনীতিতে, হীপিদের দের‌ আনা ইউরোপিয়ান দূরবীন বা রেডিও ভারতের বাজারে বিশাল দামে বিক্রি হতো। তবে সেদিন ও নেই, নেই সেই হীপিরাও। আর বাজার ছেয়ে গেছে চীনে তৈরি মালে।

বাগা বিচ ফেরত এসে ঢুকে যেতে পারেন রত্নাকর নামের বারে। সমুদ্রের ধারে বেশ বড় একটি রেস্টুরেন্ট, গমগম করে কারাওকে গানে। আর যদি একটু শান্ত পরিবেশ চান, আমার পছন্দ সুজা লোবো।

ক্যান্ডোলিম এর কাছে আরেকটি অত্যন্ত সুন্দর দুর্গ আছে। ৫০০ বছর পুরনো এই দুর্গের নাম আগুআড়া। মারাঠা আর ডাচদের থেকে সাম্রাজ্য বাচাতে পর্তুগিজরা এই দুর্গটি তৈরি করেছিল। পুরনো দিনে ইউরোপিয়ান জাহাজ এখানে দাঁড়িয়ে খাওয়া জল ভরে নিতো। এখনো একটি চারতলা লাইটহাউস দাঁড়িয়ে আছে দুর্গের ধারে।

সিনকেরেম বীচ, অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস


দুর্গের কাছেই রয়েছে সিনকেরেম বীচ। আপনি কি প্যারাসেইলিং করতে চান, বা বলিউড হিরোদের মত জেট স্কি? নাকি রাবারের ভেলায় করে সমুদ্রে কিছুটা ঘুরে আসতে চান? এই বীচেই সব রকমের ওয়াটার স্পোর্স হয়ে থাকে। মোটামুটি ৮০০ থেকে দুই  হাজার টাকা প্রত্যেকটি লোকের ভাড়া। আমি প্যারাসেইলিং করেছিলাম, সত্যি বলতে কিছুটা ভয়ে ভয়ে।

সাঁতার আমি জানিনা, আর এমন না যে অনেক মানুষ ঘোরাঘুরি করছিলেন বাঁচানোর জন্য। আকাশে ভাসতে ভাসতে নিচে আরবসাগর আর তারা এক কোনে দূর্গটি দেখতে বেশ পুলক লাগে। তবে হ্যাঁ বর্ষাকালে সব বন্ধ। আপনি যদি দক্ষিণে থাকেন, তাহলে পালোলেম বীচেও এ ধরনের অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস হয়ে থাকে। দক্ষিনে দাম টা তুলনামূলকভাবে কম। কপাল ভালো থাকলে, একটি-দুটি ডলফিন আপনার সাথে সাঁতার কেটে দেখা করে যাবে।

parasailing in Goa

উত্তর গোয়াতে, মেয়েম হৃদের ধারে, শুরু হতে চলেছে বাঞ্জি জাম্পিং। দক্ষিণ গোয়ার বেশ কিছুকাল ধরে ভোরবেলা হট এয়ার বেলুন উড়ছে। তীব্র গতিতে অ্যাড্রেনালিন দৌড়ের জন্য, গোয়ার জুড়ি মেলা ভার।

দক্ষিণ গোয়া

দক্ষিণের বীচগুলি তুলনামূলকভাবে শান্ত। সাদা বালি আর স্বচ্ছ জল, ভারতের মূল ভূখণ্ডের কাছাকাছি একমাত্র গোয়াতেই এ জিনিস দেখা যেতে পারে। দক্ষিণ গোয়া আমার প্রিয় বীচ গুলি হল: Colva, পালোলেম, পাটনেম, খোলা, ভেলসাও, বেনাওলিম। আরো নিচে আপনি কারোয়ার চলে আসতে পারেন, এখান থেকে কর্ণাটক শুরু।

গ্রীষ্মকালে বা শীতকালে, এখান থেকে ট্রেক করে দুধ সাগর ঝরনা অব্দি যাওয়া যায়। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক লোক দুধ সাগর পৌঁছতে পারেন তাই, যত সকালে সম্ভব যাত্রা শুরু করুন। কাছাকাছি গ্রামটিতে পৌঁছিয়ে আপনাকে স্থানীয় জীপ ভাড়া করে ট্রেকের শুরু অবধি যেতে হবে।

Colaba Beach Goa: things to do in south Goa

দক্ষিণ গোয়ার সমুদ্রের ধারে মানগ্রোভ জঙ্গলে নৌকা বিহার সম্ভব। একদিন নৌকো নিয়ে বাটার ফ্লাই বীচ যাওয়া যায়। এখানে, গাড়ি নিয়ে বা হেঁটে যাওয়ার উপায় নেই, কাজে খুব বেশি লোক এর ব্যাপারে জানে না। দক্ষিণ গোয়া ডাবোলিম থেকে মোটামুটি ৬০ কিলোমিটার দূরে। দুরত্বের জন্যই এখানে ভিড় কম।

বর্ষাকালীন গোয়া

এই সুমোহিনী নীল আকাশ আর নীল সাগরের প্রেমের দৃশ্য কিন্তু ক্ষণস্থায়ী। যে ক’টি দিন উত্তর ভারত শীতে থরথর কম্পমান, দক্ষিণ-পশ্চিমের এই সমুদ্র সৈকত ততদিন রোদে ঝলমল। মৌসুমী বায়ু এখানে নিয়ে আসে প্রচন্ড ঝন্ঝা। কালো মেঘ আকাশকে থমথমে করে তোলে। যে আরবসাগর সাধারনত শান্ত সুগভীর সহিষ্ণু, সে ফুঁসে ওঠে রাগে।

বৃষ্টির সময় কি গোয়া আসা যায়? যায়, যদি না সমুদ্রস্নানের বিশেষ ইচ্ছে থাকে।

এই সময় গোয়া অসহনীয় সবুজ। সবুজের পঞ্চাশটি রং। গোয়া একটি একটি করে সবুজ আপনার প্রাণে ছড়িয়ে দিতে পারবে। বর্ষার সময় যদি গোয়া আসেন, কিছুদিন হাউসবোটে থেকে দেখুন। জানি হাউসবোট কেরালার একচেটিয়া দম্ভ। গোয়া কিন্তু কম যায় না। একদিন সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যান ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে। ঘরে ফিরে আসুন দু’চারটে নারকেল হাতে করে। সমুদ্রের ধারে ও হেঁটে আসতে পারেন। তবে হ্যাঁ, জলে যাবেন না। বর্ষাকালে প্রায়ই খবরের কাগজে কিছু অসময়ে মৃত্যুর ঘটনা চোখে পড়ে। অল্প বয়সে আরব সাগর কে চ্যালেঞ্জ করার ফল বিশেষ ভাল হয় না।

আজকাল বিখ্যাত বীচ গুলিতে পাহারাদার বসে থাকে। তারাই আপনাকে জলে নামতে দেবে না।

Yab yum resort review

তাহলে গোয়াতেই দেখা হচ্ছে? কয়েকটা জিনিস মনে রাখুন।

প্রতিবছর গোয়াতে ভ্রমণকারীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, বীচে ছড়িয়ে থাকা প্লাস্টিক। দয়া করে আপনার ব্যবহার করা প্লাস্টিক টি নিজেই ফিরিয়ে আনুন। লুপ্তপ্রায় অলিভ রিডলী কচ্ছপগুলি তাহলে হয়তো কিছুদিন বেশি বাঁচবে।

যদি মনে হয় সেন্ট্রাল গোয়া অত্যন্ত বেশি ভিড়, চট করে একটু উত্তর বা দক্ষিণের দিকে চলে যান। এখানকার সমুদ্রতট প্রায় জনহীন। বিত্তশালী হোটেল হয়তো নেই কিন্তু থাকার জায়গা পেয়ে যাবেন, তুলনামূলকভাবে সস্তায়।

গোয়ার স্থানীয় মানুষ খুবই সহৃদয়। সাংঘাতিক দুষ্কর্ম এখানে হয় না বললেই চলে। গাজা খাওয়া বি ড্রাগস, বাকি ভারতের মত গোয়াতেও বেআইনি। তবে হ্যাঁ, কিছু চ্যাংড়া ছেলের দল সর্ব ঘটে কাঁঠালি কলার মত গোয়াতেও উপস্থিত। এদেরকে এড়িয়ে চলুন। একসাথে ছবি তোলার ইচ্ছাতেও সাড়া দেবেন না।

ট্যাক্স কিছুটা কম হওয়ার জন্য গোয়াতে মদের দাম কম, ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায়। তা বলে ভাববেন না আপনি যত ইচ্ছা মদ কিনে নিজের রাজ্য তে ফেরত যেতে পারেন। প্লেন বা ট্রেনের বিভাগীয় কর্তার সাথে কথা বলে জেনে নেবেন, প্রতি মানুষ কিছু কতটা মদ নিয়ে আসা যায়।

গোয়ায় খাওয়া-দাওয়া


বলাইবাহুল্য সমুদ্রের ধারের রাজ্য গোয়া, মাছের এখানে কোন কমতি নেই। বেশিরভাগই সামুদ্রিক মাছ, পমফ্রেট, চিংড়ি। রান্নায়, বিশেষত কোঙ্কণী রান্নায়, বাঙ্গালীদের মতনই নারকেলের দুধ দিয়ে ভালোবাসা উদযাপন। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে পর্তুগীজদের প্রভাব। টাটকা শুয়োরের মাংস দিয়ে কষিয়ে রান্না করা হয় ভিন্দালু। খাওয়া হয় গরম ভাত দিয়ে মেখে। প্রতিটি তরকারিতে কিছুটা টক ভাব। এই টক স্বাদের উৎস কিন্তু কোকুম ফল। সোল কাড়ি, কোকুম দিয়ে তৈরি একটি পানীয়। আর হ্যাঁ, আপনি যদি বাঙালি রান্নার খোঁজ করছেন, নিরাশ হবেন না। প্রত্যেকটি বড় সমুদ্র সৈকতে বাঙ্গালীদের জন্য বিশেষ “মিল সিস্টেম” চালু আছে। কাতলা থেকে পাবদা সব রকমের নদীর মাছ সেখানে পরিবেশিত হয়। তবে হ্যাঁ মিষ্টি পাওয়া যাবে না। মিষ্টির জন্য আপনাকে গুড় ও নারকেল দিয়ে তৈরি বিবিন্কা কেকের ওপরেই নির্ভর করতে হবে।

Goa travel blog

সঙ্গে থাকুন, ফেসবুকইন্সটাগ্রাম আর টুইটার

প্রতিমাসে আমি একবার ইমেইল করি, নতুন ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে। পড়তে চাইলে সাবস্ক্রাইব করে নিন।

Subscribe

* indicates required

3 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *