ছোটবেলায় ভূগোলের পাতায় পড়েছিলাম কচ্ছের রাণ সম্পর্কে। কচ্ছ উপসাগরের পার্শ্ববর্তী এই নুনের মরুভূমি খুবই আশ্চর্য এক ভূ-প্রাকৃতিক রূপ। বলা হয়, আলেকজান্ডার যখন ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছিলেন, এই কচ্ছের রাণ কিন্তু তখন এক উত্তাল সমুদ্র, জাহাজে করে পেরোনো যেত। পরবর্তীকালে ভূমিকম্পের দরুণ মাটির নিচে টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষ ঘটে। কিছুটা ভূভাগ উপরে উঠে আসে, কিছুটা নিচে নেমে যায়। সমুদ্র বাধ্য হয় পিছু হটতে। এখনো কিন্তু বর্ষাকালে সমুদ্রের নোনা জলের গান উঠে আসে কচ্ছের রাণ ভূভাগে। তাই যে সাদা নোনা মাটির রূপ দেখে সারা পৃথিবী মুগ্ধ তা কিন্তু বছরের ছয় মাস ডুবে থাকে সমুদ্রের তলায়।
বন্যার প্রকোপে যে সমুদ্রের লবণাক্ত জল ঢুকে আসে তার গভীরতা মাত্র কিছু মিটার। কিন্তু সেই লবণাক্ত জল সমুদ্রে ফিরে আসার আগে এই 28000 স্কয়ার কিলোমিটার বিস্তৃত মরুভূমিকে দিয়ে যায় পুরু নুনের পরত। স্থানীয় ভাষায় নুনকে বলে মিঠু। এ কচ্ছের রাণ শুধু যে ভারতের প্রতিটি মানুষের পাতে লবণ যোগান দেয় তাই নয়, সারা পৃথিবীতেও নুনের জোগাড়ে তিন নম্বর পর্যায়ে আছে।
তবে লবণ উৎপাদনের সাথে যুক্ত মানুষের জীবনযাপন কিন্তু অত্যন্ত কষ্টকর। জীবন পরিধি তাদের 50 থেকে 60 বছরের বেশি নয়। সারাদিন রোদের তাপে ওই লবণাক্ত জলে মাটিতে ভিজে কাজ করার ফলে শরীরে বাসা বাঁধে বহু রোগ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মজুরি 10000 টাকা ছাড়ায়না। এখানে মৃত্যু যে শুধু কষ্টদায়ক তাই নয়, চোখে আঙ্গুল দিয়ে একটি ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যবধান স্পষ্ট করে দেয়।
যাই হোক কচ্ছের রাণ এর ভ্রমণ কাহিনী লিখতে বসে দুঃখ দিয়ে শুরু করতে চাই না। একটি ধূসর মরুভূমি থেকে কচ্ছের রাণ আজ নিজের পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে পৃথিবীর ভ্রমণ মানচিত্রে। কোভিডের কারণে এখন হয়তো লোক কিছু কম কিন্তু 4 মাসব্যাপী শীতকালীন রাণোৎসবের কিন্তু আসল টার্গেট ক্লায়েন্ট বিদেশিরাই।
কচ্ছের রাণ রাজনৈতিক বাধানিষেধ কে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে কিছুটা নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে পাকিস্তানের দিকেও। কাজেই এই জায়গাতে রয়েছে প্রচুর মিলিটারি উপস্থিতি। আপনি যদি কচ্ছের রাণ যেতে চান অন্যান্য বর্ডার এলাকার মতনই এখানেও আপনাকে পারমিট জোগাড় করতে হবে। ধোরধো গ্রামের কুড়ি কিলোমিটার আগেই পেয়ে যাবেন পারমিট, ভূজ শহর অতিক্রম করে। অথবা অনলাইনে সেরে নিন পারমিট জোগাড়ের কাজ। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি এই মুহূর্তে ধোরধো কচ্ছের রাণের শেষ গ্রাম।
কচ্ছের রাণ যাওয়ার জন্য আপনাকে প্রথমে আসতে হবে আমেদাবাদ, ট্রেন বা ফ্লাইটে করে। তারপরে মোটামুটি সাড়ে চারশো কিলোমিটার এর যাত্রাপথ। পরেরদিন প্রস্তুত থাকুন 10 ঘন্টা রাস্তায় কাটানোর জন্য। এই দীর্ঘ যাত্রাপথ এড়াতে, আপনি সরাসরি চলে আসতে পারেন ভূজ শহরে। এখানকার এয়ারপোর্টে একদিন অন্তর প্লেন ছাড়ে। যতদূর মনে পড়ে এই ভূজ এয়ারপোর্ট কিন্তু মিলিটারির অধীনে। ভূজ শহর থেকেই আপনি ঘুরে নিতে পারেন কচ্ছের রাণ, যার অবস্থান মাত্র কুড়ি কিলোমিটার দূরে। Kutch Safari Lodge এইখানে কাটাতে পারেন কিছু রাত। সরাসরি কচ্ছের রাণে থাকা তুলনায় খরচ কিছুটা সস্তায় হবে।
ভুজ কচ্ছ জেলার একটি বড় শহর। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ভুজ শহরে যে ভূমিকম্প হয়েছিল তার স্মৃতি এখনো আমাদের মন থেকে মুছে যায়নি। ভুজে ভ্রমণের সময়, আপনি প্রাগমহল, আইনমহল, বিজয় বিলাস প্রাসাদের (shooting location for Ham Dil De Chukhe Sanam) মতো জায়গাগুলি ঘুরে দেখতে পারেন।
এই ভৌগোলিক অঞ্চলটি ভূমিকম্প প্রবণ। স্বাভাবিকভাবেই এখানকার মানুষরা যে বাড়িগুলোতে থাকেন সেগুলি ভূমিকম্প প্রতিরোধ কারী। স্থানীয় ভাষায় বলে বুঙ্গা। গোলাকার বাড়ির ভেতরে সাদা রঙের মাটি আর কাঁচের কারুকার্য। ওপরে খড়ের চাল। ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প যদি হয় আর বাড়ি যদি ভাঙ্গে তাহলে বাইরের দিকে সে ধসে পড়বে। বাড়ির ভেতরে মানুষগুলি প্রাণে বেঁচে যাবে।
10 বছর আগেও মানুষ যদি কচ্ছের রাণ দেখতে আসতেন ভূজ শহরে থেকে যেতেন। কারণ তার পরে না ছিল রাস্তা না ছিল কোন জনপদ। এখানে থাকতেন মালদারি উপজাতির মানুষজন। এনারা বেশিরভাগই মুসলমান। প্রায় কুড়ি শতাংশ দলিত হিন্দুও এখানে থাকেন। এনারা সবাই পশু পালন করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। স্বাভাবিক কারণেই প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের স্থান পরিবর্তন করতে হতো।পরবর্তীকালে কচ্ছ অঞ্চলের অনেক উন্নতি ঘটেছে।
শুধু যে ভ্রমণ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে তা নয়। তার সাথে সাথে এই মরুভূমি অঞ্চলে যথেষ্ট জল সরবরাহের ব্যবস্থা হয়েছে। উন্নত পশু পালন বিধির কারণে এখানকার বান্নি মহিষ ভারতের অন্যতম দুগ্ধ উৎপাদনকারী গবাদি পশু হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিছু মাস আগেই এখানে একটি টেস্ট টিউব বান্নি মহিষের জন্ম হয়েছে। এরা রাত্রিবেলায় প্রায় 10 12 কিলোমিটার ঘুরে ঘুরে মরুভূমির ঘাস খেয়ে বেঁচে থাকে। দিনের বেলায় আশ্রয় নেয় নিজেদের খাটালে।
তবে যা আমাকে সব থেকে বেশি আশ্চর্য করেছে তা হল এখানকার মানুষের সূক্ষ্ম কারুশিল্প। কচ্ছের শাড়ি বা জামা কাপড়ে হাতের কাজ এক অনিন্দ্য সুন্দর শিল্প। এখানে গান্ধী নু গাম এবং নিরোনা গ্রাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পারস্য থেকে আসা ট্রি অফ লাইফ নিরোনা গ্রামে গত 400 বছর ধরে স্থানীয় মানুষেরা ছবি এঁকে আসছেন। কিছুদিন আগে এই নিরোনা শিল্পের একটি নিদর্শন পৌছে গেছিল আমেরিকার হোয়াইট হাউসে ও। https://youtu.be/vFGMKzRvuys এইখানে দেখতে পারেন তার কিছু নিদর্শন। সত্যি বলতে কি, লবণের মরুভূমির থেকেও বেশি আমাকে যা আকৃষ্ট করেছে তা হলো এখানকার মানুষের হস্ত শৈলী। এ নিষ্প্রাণ রুহ্ম মরুভূমিতে এত বছর ধরে মানুষ এত বৈরী জীবন সংগ্রামের মধ্যেও সুন্দর ভাবে প্রজন্ম গত শিক্ষা এবং শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে, এর থেকে সুন্দর আর কি হতে পারে।
তবে হ্যাঁ, লবণের মরুভূমি দেখতে আপনাকে তো কচ্ছের রাণ একবার যেতেই হবে। মোটামুটি অক্টোবরের শেষ থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত কচ্ছের রান উৎসব হতে থাকে। এই সময় এখানে অনেক অস্থায়ী তাঁবু তৈরি হয়। বিভিন্ন দামের তাঁবু আছে, আছে কিছু অপেক্ষাকৃত সস্তায় হোমস্টে অপশন। মার্চ থেকে শুরু হয় গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপদাহ। সেই সময় এখানে মানুষ আসেন না। আর বর্ষাকালে তো এখানে চলে আসে স্বয়ং সমুদ্র। এ৺নার অর্ধ বছরব্যাপী উপস্থিতির জন্যই তাঁবু গুলি সব অস্থায়ী।
আমি গুজরাট ট্যুরিজম এর সাথে ভ্রমণ করেছিলাম। ডিসেম্বরের শুরুতে ওনারা একটি সপ্তাহব্যাপী অল ইন্ডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার্স মিট প্রোগ্রাম করেন। কাজেই থাকা-খাওয়া দায়িত্ব ছিল ওনাদের উপরে। উনারা আমাদের রেখেছিলেন টেন্ট সিটিতে। সত্যি বলতে কি বাঁশ দিয়ে তৈরি প্রকাণ্ড প্রবেশপথ, সুন্দর আলোক সজ্জা, এসবই আমাকে কলকাতার দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। অস্থায়ী তাঁবুগুলো কিন্তু বিশাল। এরমধ্যে এসি থেকে শুরু করে কমোড কি নেই। জানলাম এই তাবুর দাম 8 থেকে 40 হাজারের মধ্যে প্রতিটি দিনের জন্য। তারমধ্যে আপনার দিনে তিনবার খাওয়া দাওয়া দেবে। একটি তাঁবুতে একসাথে দুজন এবং একটি বাচ্চা থাকতে পারে। কিছু ইলেকট্রিক টোটো চলে অতিথিদের যাতায়াতের জন্য
গুজরাতে ঘুরতে যাওয়ার আগে যে জিনিসটা মাথায় সবার আগে আসে তা হল খাওয়া-দাওয়া চিন্তা। সবই এখানে নিরামিষ। টেন্ন্টসিটি তার ব্যতিক্রম নয়। তবে হ্যাঁ বাইরে যে ধাবা গুলি আছে সেখানে আপনি মাংস পেয়ে যাবেন। কচ্ছ ঘুরতে এসে অবশ্যই ট্রাই করবেন মোষের দুধের ঘি লাগানোর গরম জোয়ার বাজরা রুটি। মোষের দুধ গরম গরম খেতে বেশ লাগে। আরবান কচ্ছ নামে একটি জায়গাতে গিয়ে আমরা একটি রাতে বেশ সুন্দর খাওয়া-দাওয়া করেছিলাম। মোষের দুধ জাল দিয়ে তৈরি মাওয়া একটি বিখ্যাত স্থানীয় মিষ্টি।
এবার আসি আসল আকর্ষনে। যারা বাকি সব ছেড়ে কচ্ছ যাবেন নুনের মরুভূমি দেখতে তারা দয়া করে পূর্ণিমা রাত দেখে দিনক্ষণ নির্ধারণ করুন। এখানে সূর্যাস্ত অতি মনোরম, সূর্যোদয় ও তাই। কিন্তু আন্তর্জাতিক সীমানা কাছাকাছি থাকার দরুন বিএসএফের কড়া নিয়ম আছে। সকাল আটটা থেকে দুপুর তিনটে পর্যন্ত এখানে সাধারণ মানুষকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। একটি স্বাভাবিক মানুষ এই সময় কচ্ছের রাণে ঢুকতে চাইবেনও না। এই সময় সূর্যের তাপ ঊর্ধ্বগামী সাধারণত। এই ধরুন 40 ডিগ্রির কাছাকাছি। https://youtu.be/B9PedHvytCI আমার দেখা সূর্যাস্ত। সূর্যাস্তের পরে তো একদমই ঢুকতে দেবে না। তবে পূর্ণিমার রাতের দুদিন আগে আর দুদিন পরে বিএসএফ সাধারণ যাত্রীদের এলাও করে কচ্ছের রাণ দেখতে। শুনেছি, সেই সময় জ্যোৎস্নায় ভেসে যায় মরুভূমির একুল ওকুল। গোল রুপার থালার মত চাঁদ উঠে আসে যেখান দিয়ে কিছু আগেই অস্ত গেছে একটি কমলা রঙের সূর্য।
এছাড়াও একদিন সূর্যাস্তের সময় আপনি চলে যেতে পারেন কাল দুঙ্গার। এই কালো পাহাড় টি কচ্ছের সবথেকে উঁচু জায়গা। যদি কপাল ভালো থাকে তাহলে পরিষ্কার দিনে দূরে দেখতে পাবেন করাচি শহর। এখান থেকে ধোলাবিরা হ্রদ, একাল কি রাণ এই সমস্ত আকর্ষণ দেখা যায়। স্থানীয় মানুষেরা সন্তরা বাজিয়ে গান গান। এখানে একটি কালী মন্দির আছে যেখানে শেয়ালরাও নিরামিষাশী।কচ্ছ থেকে ফেরার পথে একটি রাত থেকে যান ডাসাদা নামে একটি গ্রামে। এর অপর নাম লিটল রাণ অফ কাচ্ছ্। এটি একটি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ। এখানে বন্য গাধা, নীলগাই এবং বিভিন্ন পরিযায়ী পাখি দেখা যায়। এখানেই আমি প্রথম পেলিকান দেখেছিলাম।
হাতে সময় থাকলে একদিন অবশ্যই যাবেন হরপ্পা সভ্যতার ভগ্নপ্রায় কিছু নিদর্শন দেখতে, ঢোলাভিরা নামের একটি অঞ্চলে। এটি একটি ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট। এরপরে আমি যখন আবার রাণ যাব, ঢোলাভিরার বিস্তারিত গল্প আসবে।
This is too good about information and lovely blog thanks sharing this article and help us information