চট করে দেশের বাইরে ঘুরে আসতে চান? ঘরের কাছে ব্যাংকক হাতছানি দিচ্ছে? তাহলে এই ব্লগটা পরে নিন। জেনে নিন ব্যাংকক যাবেন কিভাবে, থাকবেন কোথায়, কি কি খেতে ভুললে চলবে না আর কোথায় কেনাকাটা করবেন!
রাতের নিওন আলয় ব্যাংকক এক ভয়ানক মায়াবি শহর। আকাশ ছোয়া হোটেলগুলির একশ তলায় দাঁড়িয়ে নিচের পৃথিবীকে এমনিতেই পুরানো জীবনের প্রেমিক বলে মনে হয়। তার ওপরে, গভীর রাতে তার গতি অনেক স্লথ, শান্ত। এই সময়ে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে তারে জিগানো জায়, জীবনের কি হাল। “আর ঠিক কতগুলি উঁচু বাড়ি তৈরি হলে তার পাশে বয়ে চলা চাও ফ্রায়া নদীর জল শেষ হয়ে যাবে?” ব্যাঙ্গালরবাসী অধমের মনে শঙ্কা লেগেই থাকে!
অবশ্য নাও হতে পারে। দখিন পূর্ব এশিয়ার এই শহরটি একাধারে থাইলান্ডের রাজধানি এবং প্রথম বিশ্বের মানে “উন্নত” শহর।
ট্যুরিজ্ম ত বটেই, ব্যাঙ্কক খুব সহজেই হৃদয়ে জায়গা করে দিয়েছে প্রথমসারির অর্থনৈতিক আপিসগুলিকে। এ শহর কারুর কাছে নিশিত নগরী, কারুর কাছে আদর্শ মধুচন্দ্রিমাযাপনের ঠিকানা; কেউ মিশেলিন তারকা রেস্তোরাঁ থেকে রাস্তার ধারের অসাধারণ স্ট্রিট ফুডে খুঁজে নেন নিজের ভালবাসা।
বৈভবের আতিশজ্য থেকে ব্যাকপ্যাকিং; ব্যাংককের যেকন ধরনের ভ্রমণ শৈলীতেই বিশেষ না নেই!
ব্যাংকক পৌছনো আজকাল খুব সহজ
বিদেশযাত্রা যে আসলে ভারতে বেড়াতে যাওয়ার থেকে সস্তা হতে পারে, ব্যাংকক না থাকলে বাঙালি বুঝতই না! আজকাল এয়ার এশিয়ার সস্তার বিমানগুলি আড়াই ঘণ্টায় আপানাকে কলকাতা থেকে ব্যাংকক পৌঁছে দেবে! শুধু কলকাতা না, গৌহাটি আর ভুবনেশ্বর থেকেও এই বিমানটি ওড়ে। তবে এই সস্তার এয়ারলাইনস কিন্তু আপনাকে যেনতেন প্রকারেণ নামিয়ে দেবে ব্যাংককের পুরানো এয়ারপোর্ট, ডন মুইং-এ।
যদি বাজেট খুব টাইট না থাকে, আমি বলব ইন্দিগো বা স্পাইসজেট নিয়ে সুবর্ণ ভুমি বিমানবন্দর চলে জেতে। সামনেই মেট্রো চলে। সারা দিনরাত সহজেই শহরের ডাউনটাউন অঞ্চলে যাতায়াত করতে পারবেন।
আজকাল, ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের সীমারেখা, মনিপুরের মোরে শহর থেকে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক অবধি সোজা হাইওয়ে ছুটছে। মাঝখানে পরবে আমাদের পুরানো প্রতিবেশী বার্মা, এখনের মায়ানমার। সেখানেও একবার চট করে ঢুঁ মেরে আসাই যায়। মায়ানমারে ই ভিসা পাওয়ার আপিল করলে, দিন দুয়েকের মধ্যেই পেয়ে যাবেন। থাইল্যান্ডের জন্যে আমি ভিসা অন আরাইভাল পছন্দ করি। দশ মিনিটে হয়ে যায়। ভিড় দেখলে, ২০০ ভাট (থাইল্যান্ডের মুদ্রা, প্রায় চারশো ভারতীয় মুদ্রা) দিয়ে এক্সপ্রেস লাইনে দাঁড়িয়ে যাবেন !
থাইল্যান্ড ভিসা ফীঃ ২০০০ ভাট (প্রায় ৪০০০ ভারতীয় টাকা)
মায়ানমার ভিসা ফী (এই দেশটির গল্প পরে লিখব)ঃ ৫০$ (৩৫০০ ভারতীয় মুদ্রা)
দুটি দেশেই ভিসা অন আরাইভাল পাওয়া যায়। আপনাকে থাকার জায়গা, দেশে ফেরার টিকেট, ছমাশের ভ্যালিড পাসপোর্ট আর কয়েকটি ছবি নিয়ে লাইনে দাড়াতে হবে!
ব্যাংকক ব্যস্ত মহানগর। মানুষ এখানে হাঁটে না, ছোটে। তবে তার মধ্যেও কিছু পুরানো ওয়াট (বৌধ্ম ধর্মস্থল) এখনো সুদূর পূর্ব শ্যামদেশের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে এ শহর খাদ্যপ্রেমী, ব্যবসায়ী, ইতিহাসবিদ সবার জন্যেই পসরা সাজিয়ে রেখেছে। যদি কেনাকাটা করতে ভালবাসেন, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। জামাকাপড় থেকে শুরু করে তুলনামূলকভাবে সস্তার আইফোন, সব পাওয়া যায় ব্যাংককে!
মোটামুটি দিন তিনেক হিসেব করে রাখুন ব্যাংককের জন্যে। তবে হ্যাঁ, বড় শহর যদি আপনাকে ক্লান্ত করে, তাহলে একদিন থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে ফুকেত বা ক্রাবির দিকে এগোনোই মঙ্গল।
চাও ফ্রায়া নদী ভ্রমণ আর ওয়াট অরুন দর্শন
ব্যাংককের পাশে দিয়ে বয়ে যায় চাও ফ্রায়া নদী। সেই নদীর দুই তীরে রয়ে গেছে ঐতিহাসিক মন্দির আর রাজবাড়ি।
কিনে নিতে পারেন একটি জলের ট্যাক্সির টিকেট। সারাদিনের টিকেট (প্রচলিত ভাষায় আনলিমিটেড পাস) কিনে নিলে আপনি নদীর দুই তীর সহজেই বিচরণ করতে পারবেন। যদি সবকটি মন্দির দেখতে চান, তাহলে এটা আপনার পখে সুবিধাজনক।
অবশ্যই দর্শন করবেন, ওয়াট অরুণ। এর অন্য নাম হল সূর্যোদয়ের মন্দির। এর উলটোদিকে, নদীর পাড়ে অবস্থিত ওয়াট ফো, শায়িত বুদ্ধ মূর্তি।
অনেকের মতে, এইটি থাইল্যান্ডের অন্যতম বড় বুদ্ধ মূর্তি।
মন্দিরগুলি সাধারণত সকাল আটটা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খোলা। মন্দিরে ঢুকতে সাধারণত জনপ্রতি ১০০ বাট মত খরচ।
মনে রাখবেন, মন্দির দর্শন কালীন আপনার জামাকাপড় যেন কাঁধ ঢাকা আর হাঁটুর নিচ পর্যন্ত লম্বা হয়।
গ্র্যান্ড প্যালাস (রাজবাড়ি)
ওয়াট ফো থেকে একটু আগে এলেই দেখবেন একটি আসাধান রাজকীয় ইমারত। সোনা যেন গলে পড়ছে প্রাসাদের মাথা থেকে। এইটি হল থাইল্যান্ডের রাজপ্রাসাদ। এর অন্য নাম গ্র্যান্ড প্যালেস।
লুম্বিনি উদ্যান
ব্যাংককের মত ব্যাস্ত শহরে সাধারনত উদ্যানের জায়গা কম। তবে লুম্বিনি উদ্যান এই ঘিঞ্জি শহরে একজোড়া ফুস্ফুসের কাজ করে। এই পার্কে ঘরার সময় কিন্তু সাবধান। আমি অনেক বড় বড় গোসাপ দেখেছি এখানে।
খাও সান রোড
যদি আপনি ব্যাংককের বিশ্ববিখ্যাত পার্টি আর তার জলুশ চাক্ষুষ করতে চান, খাও সান রাস্তা একবার ঘুরে আসবেন। লিওনার্দো দি ক্যাপ্রিওর সিনেমা “দা বিচ” এখানে কিছুটা শুটিং হয়েছিলো। সস্তা বিয়ার, ইতালিয়ান কাফে, পিংপং বল সব ই চলে এখানে। পাত্তায়ার ওয়াকিং স্ট্রিটের ছোট ভাই খাওসান।
থাই দেশের বক্সিং এক্তি শিল্প কলা। এর স্থানীয় নাম হল মুয়ে থাই। হলিউড বা আমেরিকার থাইল্যান্ড অবসেসন অন্য মাত্রা পেয়েছে Ong-Bak: Muay Thai Warrior সিনেমাটিতে। খাওসান রোডে মাঝে মাঝে খোলা রাস্তায় মুয়ে থাই খেলা হয়ে থাকে।
থাই মাসাজ
হাঁটাহাঁটি করে পা ব্যাথা হলে সোজা চলে যাবেন কাছের মাসাজ পার্লারে।
থাই মাসাজ অনেক রকমের হয়। তবে যেটা আপনাকে চট করে ব্যাথা থেকে মুক্তি দেবে আর চাঙ্গা করে দেবে, সেটা ট্র্যাডিশনাল থাই মাসাজ। শরীরে কোথাও ব্যাথা থাকলে সেটা আগে থেকে বলে দেওয়া শ্রেয়, কারন থাই মাসাজ প্রেসার পয়েন্ট ব্যবহার করে।
মহানাকম স্কাইওয়াক
ব্যাংককের স্কাইলাইন ভর্তি উঁচু বিশালাকায় ইমারত। এর মধ্যে শান্তি পেতে হলে, চলে যান সোজা একটি রুফটপ বারে। আমার মতে মহানাকম স্কাইওয়াক সবথেকে সুন্দর জায়গা, বিশেষ করে সূর্যাস্তের সময়। ৭৪ তম তলায় উঠে, একটি ককটেইল নিয়ে বসে পরুন! রাতের শহর আপনার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠবে।
এছাড়াও হাতে সময় থাকলে এক দিন ঘুরে আসতে পারেন আয়ুত্যা, থাইল্যান্ডের পুরানো রাজকীয় রাজধানী। একটি বাইক ভাড়া নিয়ে সারাদিন ঘুরে দেখতে পারেন পুরানো শহরের ধ্বংসাবশেষ। এপ্রিল মাসে ব্যাংকক গেলে অবশ্যই সংরান অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করবেন। অনেকটা আমাদের দোল উতসবের মতন, কিন্তু সংরান জল দিয়ে খেলা হয়।
সি ওয়ার্ল্ড /সাফারি ওয়ার্ল্ড অনেকের পছন্দের তালিকায় পরে। কিন্তু আমার পশুপাখি কে বন্দী করে, দাস বানিয়ে তাদের নিয়ে খেলা দেখানোতে ঘোরআপত্তি আছে। তার থেকে বরং এর পরে একটা আফ্রিকা ঘুরে আসার প্ল্যান করুন, নিদেন পক্ষে ঘরের কাছে আসামের কাজিরাঙ্গা?
ব্যাঙ্ককে খাওয়াদাওয়ার খোঁজে
যদি আপনি খাওয়া নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালবাসেন, তাহলে ব্যাংকক আপনার জন্যে আদর্শ গন্তব্য।
প্রথমেই বলব, রাত্রের বেলা আপনি চাইনা টাউন যাবেন ডিনার করতে।
চিনের চেয়ারম্যান এদের কেউ নয়, কিন্তু চীনা কিছু নাবিক থেকে গেছিলেন নদীর পাড়ে। তাঁদের রান্না করা গ্লাস নুডলস আর সাথে কিছু গ্রিলড চিংড়ি আপনাকে স্বর্গ দর্শন করাবে, এই আমার দাবী।
ভাসমান বাজার
কোন একটি সপ্তাহের শেষে চলে যান কাছের কোন ফ্লতিং মার্কেট, ভাসমান বাজার। এইটি, থাই সংস্কৃতির বিশাল অঙ্গ। বেশ কিছু ফ্লতিং মার্কেট আছে যেগুলি টুরিস্টদের জন্যেই বানানো। আর একটু দূরের গুলি আপনাকে স্থানীয় মানুষদের ভিড়ে আলাদা করে দেবে। আমার পছন্দের বাজারটি হল Khlong Lat Mayom Floating Market।
সবরকমের মাছ ভাজা থেকে শুরু করে পাতুরি ধরনের রান্না বিক্রি হয়। সাথে পাবেন স্তিকি ভাট, বিভিন্ন সুপ, ডিম, কচি ডাবের জল।
শহরের মধ্যেই কিছু রাস্তা, যাদের সই নামে চেনা যায়, সেখানেও পেয়ে যাবেন পছন্দের খাবার। সই ১১, সই ৩৮ দুটি ই আমার খুব পছন্দের খাওয়ার জায়গা।
হাশের মাংস আর আম-ভাত খুব পছন্দের জিনিস এখানে!
সস্তায় সেরা শপিং করার ঠিকানা হল এম বিকে আর সিয়াম পারাগন, এই দুটি মল। তবে সাবধান, এখানে কিন্তু জামাকাপড় ট্রাই করার সুযোগ নেই। যদি ফোন বা ল্যাপটপ কেনেন (ব্যাঙ্ককে এগুলি বেশ সস্তা) তাহলে ভাট রিসিপ্ত নিয়ে রাখবেন। দেশ ছাড়ার সময়ে বিমানবন্দরে ট্যাক্স ফেরত নিতে ভুলবেন না!
আর বেশি সস্তায় জিনিস কিনতে চাইলে চলে যান ছাতুছাক বাজার। শুধুমাত্র শনি আর রবি, এই দুদিন বসে বাজারটি। পোষার কচ্ছপ থেকে শুরু করে সুন্দর কানের দুল, সব পাওয়া যায় এখানে।
ব্যাংকক শহরের ভেতরে কিভাবে ঘরাঘুরি করবেন
ব্যাঙ্ককে গ্রাব ট্যাক্সি চলে অনেক। তাছাড়া পেয়ে যাবেন আকাশপথের মেট্রো রেল বা বি টি এস, যা ব্যাংকক শহরের দূর দুরান্ত যোগ করে রেখেছে।
কখন যাবেন
সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী ব্যাংকক যাওয়ার সবথেকে ভাল সময়। শীতকাল, ঠাণ্ডা থাকে।
তবে, গরমকালে খুব ঘেমো আবহাওয়া, আর বৃষ্টির সময়ে যখন তখন বৃষ্টি, এই দুটো প্রবলেম বাদ দিলে ব্যাংকক সারা বছর যাওয়া যায়।
সঙ্গে থাকুন, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম আর টুইটার।
This post may contain affiliate links. Please read the disclosure post. If you have liked the article, you may support it by buying using these links without any extra cost to you
One Response