লুয়াং প্রবাং একটি ইউনেস্কো দ্বারা চিহ্নিত প্রাচীন শহর। ইউনেস্কো মর্যাদা প্রাপ্তির কারণ, “best preservation of architecture”। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাকি দেশগুলোর মতো লাওস ( কিন্তু উচ্চারিত হয়, লাও নামে) ইতিহাসের অনেক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে এসেছে। কখনো চীন, কখনো জাপান এবং দীর্ঘকালীন ফরাসি কলোনি শাসন সহ্য করেও, লুয়াং প্রবাং কিন্তু নিজস্বতা ভুলে যায়নি। অসংখ্য বৌদ্ধ মন্দির এবং ফরাসি স্থাপত্য, এই দুইয়ের মিশ্রণে লুয়াং প্রবাং স্বতন্ত্র।
দু’বছর আগে জুলাই মাসে আমি গিয়েছিলাম লুয়াং প্রবাং। সাত দিনের ভ্রমণ। দুদিনের জন্য আমরা নং খিয়াও (Nong Khiaw) নামের একটি ছোট্ট গ্রামে ছুটি কাটিয়ে ছিলাম, বাকিটা লুয়াং প্রবাং।
লুয়াং প্রবাং পৌঁছনোর সবথেকে আকর্ষণীয় পদ্ধতি হল পুরানো কাঠের বজরা ভাড়া করে, উত্তর থাইল্যান্ডের চিয়াং মাই শহর থেকে মেকং নদীর ওপর ভেসে চলা। কিছুদিন আগে অব্দিও এইসব জায়গাতে খুব বেশি টুরিস্ট আসতেন না। কিন্তু দিন পাল্টেছে, মানুষের উৎসুক্য অনেক বেশি।
মেকং নদী যাকে স্থানীয় মানুষেরা মাদার মেকং বলে থাকেন, আর নাম খান- এই দুই নদীর সংযোগস্থলে অবস্থিত লুয়াং প্রবাং। চারদিকে ছোট ছোট পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে ঘন জঙ্গল। এই পাহাড় গুলিকে ড্রাগন হিসেবে অভিহিত করা হয়, যেন এরা শতাব্দী প্রাচীন জাগরুক প্রহরী। বাইরের কোন শত্রুকে ঢুকতে দেবেনা।
ভারতীয়দের লাও সরকার, চল্লিশ ডলারের বিনিময়ে ভিসা অন এরাইভাল দেয়। তার মেয়াদ হল এক মাস। সাতদিন ঘোরার জন্য ফ্লাইট আর ভিসার খরচা বাদ দিয়ে, আপনার খুব বেশি হলে ত্রিশ হাজারের মতো খরচা পড়বে। খুব বৈভব শালী হোটেলেও থাকতে পারেন আবার ব্যাকপাকিং-ও করতে পারেন। ব্যাকপাকিং এর খরচা অবশ্যই অনেক কম।
লুয়াং প্রবাং থেকে যত ভেতরের দিকে ঢুকবেন খরচা ততো কমে যাবে। লাও একটি কমিউনিস্ট দেশ। এখানে ব্যবসা প্রাথমিকভাবে কৃষিনির্ভর। তার ওপরে আছে চীনের জাগ্রত চক্ষু। এ মুহূর্তে লাও তে যত ট্রেনলাইন বা নদী বাঁধ তৈরি হচ্ছে সবেতেই চীনের বিনিয়োগ আছে। তাছাড়া দেশটির চারদিকে আরো চারটি দেশ, সমুদ্রের বালাই নেই। তবে সেই অভাব মেকং নদী অনেকাংশে পূর্ণ করে দিয়েছে।
লুয়াং প্রবাং থাকাকালীন রাত্রিবেলায় একটি স্থানীয় বাজার ঘুরে দেখতে ভুলবেন না। এখানে মহিষ একটি অত্যন্ত দামি প্রাণী। মোষের মাংস এবং সসেজ সব জায়গায় পাওয়া যায়। মুরগি হাঁস এসব পাওয়া যায়। আগ্রহী হলে হাজার বছর পুরনো ডিম খেয়ে দেখতে পারেন। আর আছে কাঠগোলাপ, এবং কাঠগোলাপ দিয়ে তৈরি স্থানীয় তাড়ি। লাও কফি আর ফরাসি রুটি অত্যন্ত বিখ্যাত।
আমরা একদিন একটি কাঠের নৌকো করে পাড়ি দিলাম লুয়াং প্রবাং থেকে আরও ভেতরে গ্রাম্য রাস্তা ধরে। পৌঁছে গেলাম কুয়াংশি জলপ্রপাত। এত সুন্দর ঝরনা আমি খুব কমই দেখেছি। অসংখ্য কাসকেড, সাঁতার কাটা যায়। পাশে একটি চাঁদ ভাল্লুক ( moon bear) রক্ষার ব্যবস্থা।
স্থানীয় আদিবাসী গ্রামে একদিন অংশগ্রহণ করেছিল বাকি অনুষ্ঠানে। এখানে মুখের কথার দাম অনেক বেশি। লেখালেখি বা দলিলপত্র যা কিছু পশ্চিমী বা আধুনিক সভ্যতার দান তার প্রবেশ ঘটেছে অনেক পরে। বাকি উৎসবের প্রধান বৈশিষ্ট্য এরা আপনার হাতে কিছু মন্ত্রপূতঃ সুতো বেঁধে দেবে। এর মানে আপনাদের শত্রুতা শেষ, এই সুতোগুলি বন্ধুত্বের উদযাপন।
আমাদের যাত্রা শেষ হয়েছিল নাম ও নদীর পাশে নং খিয়াউ (Nong Khiaw) গ্রাম। এই গ্রামটির আশেপাশে অনেক পাহাড় এবং গুহা। এই অদ্ভুত ভূগোল কিন্তু কুখ্যাত ভিয়েতনাম যুদ্ধের সাক্ষী। এখনো আশেপাশে প্রচুর যুদ্ধে ব্যবহৃত বোমা এবং ফাইটার জেটের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। বিশেষত পাঠক নামের গুহাতে অবশ্যই যাবেন। এইখানে লুকিয়ে থাকে রীতিমত একটি সরকার চালানো হতো। হসপিটাল থেকে শুরু করে ব্যাঙ্ক সবকিছুই গুহা থেকে চালিত হতো। যুদ্ধের শেষ দিকে এই গুহাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় এবং টানা তিন দিন আগুন জলে এখানে।
তিন দিনে লুয়াং প্রবাং
ব্যাংকক থেকে ভোটের ফ্লাইট ধরে সকাল-সকাল পৌঁছে গেলাম লুয়াং প্রবাং। ব্যাংকক এআর ওয়েজ ফ্লাইট। এখানে জলখাবার ও দেওয়া হয়, এআর এশিয়ার মত মিতব্যয়ী প্লেন নয়।
আমি ট্রাভেল ব্লগার হওয়ার সুবাদে লাও গভমেন্টের একটি প্রতিনিধিদলের সাথে ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছি। এয়ারপোর্ট এর বাইরেই শীততাপ নিয়ন্ত্রিত একটি মিনিভান দাঁড়িয়েছিল আমাদের জন্য। তাতে চেপে পনেরো-কুড়ি মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম সফিটেল হোটেল।
একটি পুরনো ফরাসি গভর্মেন্টের বাংলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে তৈরি হয়েছে এই আধুনিক হোটেল। বিলাসিতা এখানে সহজ এবং সাবলীল, উচ্চকিত নয়।
একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। আমার খাটের চারদিকে সাদা নরম কাপড়ের আবরণ দেওয়া মশারি। খাটটি সেগুন কাঠের। ঘরের পাশেই একটি ছোট্ট বাগান, সেই বাগানে একটি খোলা বাথটাব। উঁচু দেয়াল পেরিয়ে কেউ তাকাতে পারবেনা। তবে হ্যাঁ হোটেলের পোষা দুটি খরগোশ আছে। তাদের একজনকে হঠাৎ চলে আসতে দেখেছিলাম চান করার সময়।
এত বাহুল্য, কিন্তু এখানে জলের ব্যবস্থা কাঁচের পুনর্ব্যবহারযোগ্য বড় বোতলে, প্লাস্টিক দেওয়া হয়না। ময়লা ফেলার জন্য ডাস্টবিন এর নিচে রাখা আছে একটি কচু পাতা। নরম হলুদ আলোতে, জেলার বাইরে সারারাত জেগে দাঁড়িয়ে থাকে কাঠগোলাপ ফুলের গাছ। দু’একজন লাও মহিলা রাত দশটার সময় এসে দরজায় উপস্থিত, হাতে বাঁশের কৌটো, কৌটোয় তিল আর ভাত দিয়ে তৈরি ত্রিকোণ শেপের নাড়ুর মত একটি মিষ্টি। শুভ রাত্রি, বলে তারা চলে যায়।
সকালে উঠে চলে আসতে হবে প্রাতঃরাশের জায়গায়। সেকি বিশাল প্রাতঃরাশের ব্যবস্থা, দুধ কনফ্লেক্স, প্যানকেক, বিভিন্ন রকমের মৌসুমী ফল, ভাত মাংস মাছ নুডুলস, মাফিন, ব্যাগেত নামের ফরাসি রুটি, বিভিন্ন ধরনের চিজ: পাওয়া যায় না এমন কিছুই নেই। আমি একটু দই আর তার মধ্যে নানা রকমের ফল আর মুসলি মিশিয়ে খেতে বেশি পছন্দ করতাম।
হোটেলের মাঝে একটি বিশালাকায় সাঁতার কাটার পুকুর। কিন্তু সে তো যেকোনো বড় হোটেলে থাকে। সফিতেলে সুইমিংপুলের পাশে আছে একটি পদ্মপুকুর।
একদিন বিকেলে আমরা ব্যাকস্ট্রিট একাডেমী নামে একটি স্থানীয় ভ্রমণ সংস্থার সাথে লাও খাদ্য খুঁজতে বের হলাম।
বুঝতেই পারছেন যেহেতু এখানে একসময় ফরাসিরা ছিলেন এবং বিলাসীতা পূর্ণ হোটেলের কোন অভাব নেই এখানে, খুব ছোট ছোট হোটেলও ভালো, মানে অত্যন্ত ভালো ফরাসি খাওয়া পরিবেশন করে থাকে। কিন্তু সে তো আমি ভিয়েতনামেও খেয়েছি। আমার দরকার ছিল স্থানীয় খাওয়া, যা লাও মানুষজন খেয়ে থাকেন।
আপনারা হয়তো জানেন এশিয়া মহাদেশের লঙ্কার আবির্ভাব হয়েছে পর্তুগীজদের হাত ধরে। পর্তুগিজরা হয়তো লাও এসে পৌঁছয় নি এখনও।। এখানে লঙ্কার জায়গায় এক ধরনের মশলা কাঠ ব্যবহার করা হয়। শুনতে অবাক লাগলেও এখানে ঝোল জাতীয় খাদ্য গুলো কিন্তু যথেষ্ট ঝাল।
পাহাড়ি ছত্রাক, পুকুরের এবং নদীর মাছ, বিভিন্ন ধরনের সবজি, হাজার বছর পুরনো ডিম আর মোষের মাংস এখানকার প্রধান খাবার। অবশ্যই ভাত মানে যাকে স্টিকি রাইস বলা হয় তাছাড়া লাও মানুষের খাওয়ার পাত পূর্ণ হয়না। বার্মিজ দের মত এখানেও মানুষ খায় সয় নামে এক ধরনের নুডলস সুপ খেয়ে থাকেন।
যেহেতু চারদিকে চারটি দেশ এবং সমুদ্রের কোন চিহ্ন নেই লাও-য়ের মাছের স্বাদ অনেকটা আমাদের বাংলাদেশ এর মতনই। মিষ্টি জলের মাছ। জুলাই আগস্ট মাসে যদি লাও যান তাহলে কপাল ভালো থাকলে গলদা বা বাগদা চিংড়ি ও পেতে পারেন।
এখানে নাইট মার্কেট খুব ফেমাস। দূর দূর থেকে পাহাড়ি আদিবাসী গ্রামের মানুষজন পসরা সাজিয়ে আসেন। মোষের শিং থেকে তৈরি শি্ংগা, বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ারের চামড়া দিয়ে তৈরি বাদ্যযন্ত্র, সাপ এবং কাঁকড়া বিছে ভিজিয়ে রাখা হুইস্কি, পুরনো মন্দিরের ভগ্নাংশ, এইসব অদ্ভুত জিনিস বিক্রি হয় লুয়াং প্রবাং এর রাতের বাজারে। এই বাজারের ই এক ধারে বসে খাওয়া নিয়ে কিছু মানুষ। একে বলা হয় লাও বুফে। আপনি ধরুন পনেরো হাজার কিপ দিলেন, আপনাকে একটি বাটি দেওয়া হবে। সেই বাটি ভর্তি করে আপনি একবারই মাত্র বুফে থাকে খাওয়া নিতে পারবেন।
বুফে ভর্তি বিভিন্ন রকমের খাওয়া, মাছ মাংস ডিম তো আছেই, তার সাথে আছে বিভিন্ন রকমের ফল আর সবজি। আমার মতে সস্তায় পুষ্টিকর। রাতের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে বাইরে বেরিয়ে আসুন আর পাঁচ কিপ দিয়ে কিনে নিন একবাটি নারকেলের প্যানকেক। এই অসাধারণ মিষ্টি আমি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোন দেশে পাইনি। একে কেরালাতে পুটু নামে বিক্রি করা হয় যদিও ভারতে পুটু খুবই মশলাদার একটি খাদ্য।
পরদিন সকালে উঠে আমরা সোজা চলে গেলাম স্যাফরন ক্যাফে। যেহেতু লাও এবং আশেপাশে দেশগুলিতে একসময় ফরাসি এবং ইউরোপের বিভিন্ন মানুষজন আনাগোনা করতেন তারা এখানকার পাহাড়ি ঠান্ডা এবং মেকং নদীর পলিতে উর্বর জমিতে কফি ফলানোর এক্সপেরিমেন্ট করতে পিছপা হননি। তার ফলস্বরূপ ভিয়েতনামিজ কফি আজ জগদ্বিখ্যাত। আমার মতে লাও কফি কিছু কম যায় না। কিন্তু যেহেতু লাও এখনো ভ্রমণপিপাসুদের কাছে অনেকটাই অজানা, এখানকার কফি অনাগত কফি প্রেমীদের কাছে একটি সুন্দর সারপ্রাইজ হয়ে অপেক্ষা করে।
স্যাফরন ক্যাফে থেকে আমরা একটি ছোট সরু কাঠের নৌকো পাড়ি দিলাম মেকং নদীর বুকে। মোটামুটি পাঁচ মিনিট নৌকো চললেই আপনি লুয়াং প্রবাং এর শহরে মুখ ছেড়ে শান্ত সুন্দর লাও গ্রাম্য সভ্যতায় পদার্পন করবেন। তার সৌন্দর্য অনস্বীকার্য। গ্রামদেশে লাও দেখলে আপনি বুঝতে পারবেন হয়তো লাও পৃথিবীর অন্যতম গরিব একটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে কিন্তু মানুষ এখানে প্রকৃতি নির্ভর এবং সেই কারণেই হয়তো কিছু নোট, তাকে এখনো অসহিষ্ণুতা আত্মসর্বস্ব করে তুলতে পারেনি।
নদীর পার পলিমাটিতে পিচ্ছিল। যেহেতু লাও সমুদ্রতল থেকে কিছুটা উপরে এখানে মেকং নদী অত্যন্ত গভীর। কথাপ্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি মেকং কিন্তু পৃথিবীর সপ্তম বৃহৎ নদী এবং কিছু না হলেও এই নদী ছটি দেশের ষাট লাখ মানুষকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে।
আমাদের দেখায় এক জেলের সাথে। মাছ ধরছিলেন। আমাদের অনুরোধে আরো বেশ কয়েকবার জাল ফেললেন নদীতে আমরা ক্যামেরা বাগিয়ে খচখচ করে ছবি তুলে নিলাম। আশেপাশে আরো অনেক ছোট ছোট নৌকো। সেই নৌকায় করে ছোট ছোট বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে, স্কুল থেকে ফিরছে। কয়েকটি বাচ্চা দেখলাম মাটিতে হাটছে ,হাটার সময় নৌকোর লগ ব্যবহার কর চলেছে। নদীমাতৃক সভ্যতার সন্তানরা হয়তো এমনই হয়।
গ্রামের ভেতরে দুপা চলতেই আবার সেই জেলের সাথে দেখা। উনি অত্যন্ত উৎসাহভরে আমাদের ওনার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সে বাড়িতে উনি থাকে আর থাকে তিনটি বিড়াল। একটি মা বিড়াল হত্যার দুই বাচ্চা। বোঝা গেল উনি ওই বিড়ালের জন্য মাছ ধরছিলেন। তার থেকে দুটি মাছ নিজের জন্য সরিয়ে রাখেন।
লাও মানুষজন অ্যানিমিস্ট। তারা পূর্বপুরুষ এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিকে পূজা করে থাকেন আর বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব তো আছেই এখানে বুদ্ধিস্ট মনাস্তেরি গুলিতে বাচ্চাদের পড়ানো হয় আপনারা যে ছোট ছোট মওতের দেখবেন তারা কিন্তু সবাই যে বড় হয়ে মন কি হবে তা নয় অনেকে পড়াশোনা করার জন্য মনস্ট্রিতে আসে কিছুটা বড় হয় এবং শিক্ষা লাভ করে ফিরে যায় সাধারণ জীবনে।
আমার প্রথমে থামলাম লাও বাফেলো গোয়ালে।
একজন অস্ট্রেলিয়ান মহিলা তার কর্পোরেট ক্যারিয়ার মাঝপথে ছেড়ে লাও দেশে এসে মোষের দুধের ব্যবসা করছেন। সত্যি কথা বলতো কল্পনীয়।
ওয়াটার বাফেলো লাও-এ অগুনতি। কিন্তু এখানকার স্থানীয় মানুষ, আসলে পুরো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং চীনের সাধারণ মানুষ দুধ বা দুগ্ধজাত খাদ্য বেশি ব্যবহার করেন না। অথচ ক্রমবর্ধমান ট্যুরিজম এর সাথে দুধের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। লাও বাফেলো গোয়াল এই ব্যবসার প্রয়োজন সিদ্ধ করতেই জন্ম নিয়েছে। মুর জাতীয় একটি মহিষ, যার নাম ফার্দিনান্দ তাকে আনা হয়েছে চীন থেকে। আসলে তার বাবা-মা ভারতীয়। আর আপনি ভাবছিলেন মাইগ্রেশন খালি মানুষের জীবনে হয়? এই ফার্দিনান্দ ই এখানে বাচ্চা মহিষগুলির বাবা।
রিকোটা চিজ বল থেকে শুরু করে বাগানের পাকা টমেটো আর ক্রিম চিজ দেয়া বিস্কিট আর চিকেন ক্রয়স্যান্ট স্যান্ডউইচ খেয়ে আমরা রওনা দিলাম কুয়াংশি জলপ্রপাতের দিকে।
কুয়াংশি জলপ্রপাত
কুয়াংশি জলপ্রপাতের সৌন্দর্য বর্ণনা করার মত ভাষা আমার জানা নেই। আপনি যদি ছবি তুলতে পছন্দ করেন এবং সেই ছবির পোস্ট প্রসেসিংয়ের জন্য লাইটরুম ব্যবহার করেন, তাহলে যত ধরনের অ্যাকুয়ামেরিন রং আপনি দেখেছেন তার চাক্ষুষ প্রকৃত সৌন্দর্য দেখতে হলে চলে আসুন কুয়াংশি।
কুয়াংশি জলপ্রপাতের অনেকগুলো ধাপ কিছু কিছু তাতে আপনি সাঁতার কাটতে পারবেন। বিকিনি পরতে পারেন আবার বুরকিনি ও পড়তে পারেন, এখানে কোন ডিসক্রিমিনেশন নেই। সাঁতার জানা বাঞ্ছনীয়। কিছু কিছু জায়গায় বুক অব্দি জল। কিন্তু পিচ্ছিল রাস্তায় আপনি আছাড় খেয়ে পড়ে যেতে পারেন সেক্ষেত্রে সাঁতার জানা জরুরী।
কুয়াংশি জলপ্রপাতে আপনি আরামসে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারবেন সাইকি তারও বেশি। সবথেকে লম্বা জলপ্রপাত এখানে ষাট মিটার মাত্র। তারপরে একটি ধুলোময় রাস্তা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে উপরে উঠে গেছে আরো উপরে। আমি উঠতে পারিনি, কারো শাড়ি পড়ে গেছিলাম আর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছিল। ভালো কথা, বৃষ্টির সময় কুয়াংশি না যাওয়াই ভালো। কারণ তখন কাদামাখা জল অত্যন্ত তীব্র বেগে প্রবাহিত হয়। কুয়াংশির যে ছবি আপনি এইখানে দেখছেন সেই রূপ কিন্তু থাকেনা।
ছোট ছোট মাছ আছে এই জলপ্রপাতে। আপনার পায়ে হালকা হালকা কামড়াবে। আশেপাশে প্রচুর ঘনসবুজ জঙ্গল। গভীর লাল পঞ্চ জবা ফুটে থাকে সেই গাছপালার আড়ালে আবডালে।
আপনি যদি ভ্রমণপিপাসুদের মত লুয়াং প্রবাং এর যা যা করার আছে সব করতে চান, তাহলে আরো দুটো দিন হাতে রাখুন। একদিন কাছে পিঠের গুহা গুলি পরিদর্শন করে আসুন। একটা দিন পুরানো মঠ গুলিকে পরিদর্শন করুন। সোনালী শিখর এবং ঘন লাল কাঠের তৈরি বৌদ্ধ মঠ কম করে হলেও পাঁচশ বছর পুরনো।
দূর গ্রামে থেকে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা শহরে সকালবেলা হেঁটে হেঁটে আসেন ওনাদের উদ্দেশ্য মাধুকরী।শহরের স্থানীয় বাসিন্দারা যার যার সামর্থ্য সে অনুযায়ী ওনাদের ঝুলিতে উজাড় করে দেন, কিছু স্টিকি চাই, কলা ইত্যাদি। আজকাল এই মাধুকরী পশ্চিমী ট্যুরিস্টদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি ইভেন্ট। আপনি যদি যান ছবি তুলতে, দয়া করে সম্মানজনক ব্যবহার করবেন।
লুয়াং প্রবাং এর মন্দিরে দেওয়াল গুলি আমার সবথেকে বেশি আকর্ষণীয় লেগেছিল প্রত্যেকটি দেওয়ালে হাজার হাজার গল্প লেখা ছবি। অনেকটাই ইজিপ্টের হায়ারোগ্লিফিক লিপি মত।
মোষ, বাঘ, গন্ডার, গুরু-শিষ্য, বাজার সমস্ত কিছুর ছবি আঁকা। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পুরাতন মেকং নদী। গুরু বসে আছেন শিষ্যদের মধ্যে, কিছু কৃষক চাষ করছে ধানি জমিতে।
আমি যদি আর একবার লাও ফিরতে পারি, আমি কিন্তু এসব কিছুই করব না হয়তো একদিন ভোরবেলা কুয়াংশি জলপ্রপাত ঘুরতে যাব তাছাড়া আমার ইচ্ছা আছে মেকং নদীর ধারে সারাদিন বসে থাকা। হয়তো নদীতে নৌকা ও চড়বো, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি আমি খালি নদীর ধারে বসে থাকতে চাই। সেই পুরনো কাঠের সাঁকো, যার ওপর দুটি মানুষ ছুটলেই সে ভয়ঙ্করভাবে নড়বড় করে ওঠে। সেই কুখ্যাত কাঠের সাঁকো, যাকে প্রত্যেকটি বর্ষাকালে মেকং নদীর বিপুল সম্ভার ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু মানুষ বড়ই জেদি। কিছু মাসের মধ্যে আরো একটা কাঠের সাঁকো তৈরি করে দেয়। যদিও সে জানে পরের বছরে বৃষ্টিতে এই সাঁকো ভেঙ্গে যাবে আবার। এই অনির্বায্য ঘূর্ণনে বৃত্তেই লুয়াং প্রবাং এর জীবনযাপন।
চলুন দেখি লুয়াং প্রবাং এর বাইরে কি আছে। আপনি অবশ্যই চলে যেতে পারেন ভিয়েনতিয়েন, লাও দেশের রাজধানী। অথবা চলে যান ভাঙ ভিয়াং। অ্যাডভেঞ্চার প্রেমীদের জন্য আদর্শ জায়গা।
কিন্তু আপনি যদি আমার মতো শান্তির খোঁজ চান তাহলে এসব জায়গায় রাখুন আর চলুন ঘুরে আসি নং খিয়াও।
নং খিয়াও
লাও থেকে মোটামুটি চার ঘন্টা বাস জার্নি। মাঝপথে লুই আদিবাসীদের গ্রামে একটি ছোট বিরতি নিন।
আমরা যখন লুই গ্রামে পৌঁছলাম, এই পুরোনো চিনা আদিবাসীদের গ্রামের মানুষজন হাতে স্বাগতম পানীয়- স্থানীয় চা এবং একমুখ হাসি নিয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
পুরনো একটি গ্রাম, একদম সোভিয়েত ম্যাগাজিনের প্রোপাগান্ডা পাতা থেকে উঠে আসা। কাঠের বাড়ি, দোতলা। নিচতলা হাঁস মুরগি ছাগল কুকুর থাকে আর আছে তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের জিনিস, কোথাও হয়তোবা তাঁতির তাঁত ঘর, কোথাও জেলের মাছ ধরার জাল। দোতালায় মানুষ থাকেন। পুরানো একটি টিভি, বেশকিছু ক্যালেন্ডার, একটি ভাঙা চিনেমাটির ফুলদানিতে কিছু নতুন ফুল, বেশ কিছু পুরনো খাতা বই আর ছোট নিচু শোয়ার খাট: এই নিয়ে সাধারণের মধ্যে অসাধারণ এই লুই গ্রামের বাড়ি গুলি। সবকটি কাঠের তৈরি।
নীল চাষ এখানকার অন্যতম ব্যবসা। দেড় হাজার ভারতীয় টাকায় আপনি যা অসাধারণ হাতে বোনা স্কার্ট বা কাপড়ের টুকরো পাবেন তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। একটা উদাহরণ দিই, এই গ্রাম থেকে আমি কিছু স্কার্ফ কিনেছিলাম, সে ধরনের স্কার্ফ আমি পরে ফাবিন্ডিয়াতে দেখি যা দাম অন্তত 8 গুণ ছিল। তিন বছর হয়ে গেছে। আমি এখনো পড়ি, কোথাও কিছু ছেড়ে নি, কোন রং উঠে নি।
বাসি অনুষ্ঠান
এই লুই আদিবাসীদের গ্রামে আমরা বাসি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি।
বাসি একটি অত্যন্ত পুরনো স্থানীয় প্রথা। একটি গোলাকার পাশের পাত্রের চারদিকে মানুষ বসে অনেকক্ষণ ধরে মন্ত্র পড়ে। পাথরের উপরে সাজানো থাকে বিভিন্ন ধরনের খাওয়া এবং সাদা রংয়ের নতুন সুতো। হাতে বোনা সুতো। এক ধরনের পুজো বলতে পারেন। অনুষ্ঠানটি শুরু হওয়ার আগে যিনি পুরোহিত উনি একটি পাত্র থেকে উপস্থিত সকলের মাথায় জল ছিটিয়ে দেন কিছু গাছের পাতা দিয়ে।
বাসি অনুষ্ঠানের অর্থ ওনারা আমাকে ওনাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করলেন। অনুষ্ঠানের শেষে ওরা আমার হাতে ওই সূত্রগুলি বেঁধে দিয়েছিলেন। অন্ততপক্ষে কুড়িটি সুতো ছিল হাতে। নিয়ম হলো ওই সূত্রগুলি তিন দিন রাখা। আগেকার দিনে যখন খবর পৌঁছতে বেশ কিছুদিন সময় লাগত, তখন নতুন যারা এডভেঞ্চার করতে এই পাহাড়গুলি আসছেন, এ সূত্র গুলি তাদের রক্ষাকবচ কাজ করতো। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো প্রতিটি মানুষের গ্রামের সুতো বোনার ডিজাইন কিন্তু অন্যরকম। সত্যি কথা বলতে কি এনাদের সুতলি শিল্প নৈপুণ্য, এনাদের স্বকীয়তা দেয়।
এখানে কিছু হোমস্টে আছে। এই হলো তাদের নাম্বার বা যোগাযোগের ঠিকানা:
আপনি যদি গ্রামীন ভ্রমণ (Rural tourism) পছন্দ করেন অবশ্যই এই গ্রামে কিছুদিন থাকুন। মানুষের উপর বিশ্বাস ফিরে পাবেন। এই মানুষ গুলোর জন্যই লাউ নিয়ে আমার ভালো ছাড়া আর কিছু কথা বলার নেই।
এখান থেকে আরো দু’ঘন্টা বাস জার্নি করে আমরা পৌঁছলাম নাম ও নদীর ধারে। কিছুকাল আগেও, নং খিয়াও বাকি পৃথিবীর থেকে অনেক দূরে পাহাড়ের গায়ে হারিয়ে যাওয়া একটি গ্রাম ছিল। কিন্তু এখন পৃথিবী আস্তে আস্তে পাল্টে যাচ্ছে বদলে যাচ্ছে অনেক রাজনৈতিক সম্পর্ক। একটি বড় সিমেন্টে ব্রিজ গ্রামের দুই পার্কে যুক্ত করেছে। নাম ও নদীর নৌকাগুলি চুপ করে ব্রিজের ব্যস্ততা দেখে আজ। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা ভালো এ ব্রিজটি তৈরি করেছে চীন। এ রাস্তাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই একই রাস্তা দিয়ে লাউ, ভিয়েতনাম এবং চীন যুক্ত।
নং খিয়াও-এ আমরা রিভার সাইড রিসোর্ট নামে একটি হোটেলে ছিলাম। নদীর ধারে ছোট ছোট কটেজ। কটেজের বারান্দা থেকে দিনরাত নদীটিকে দেখা যায় ।বৃষ্টি হলে নদীর চেহারা পাল্টে যায়। তখন এখানে নৌকা চালানো মুশকিল। যেকোনো সময় বন্যা হতে পারে। যারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ভ্রমণ করেন তারা জানেন, এখানকার ভূমিরূপ একটু অন্যরকম। মাঝে মাঝে মনোলিথিক লাইমস্টোন পাহাড় দেখা যায়, মনে করুন হালং বে, ভিয়েতনাম বা থাইল্যান্ডের ফাং এনগা বে।
নং খিয়াও ওরকমই জায়গা, তবে সমুদ্রের পরিবর্তে একটি নদী পাহাড় কেটে এগিয়ে চলেছে। পর্যটনের জন্য আস্তে আস্তে নং খিয়াও পৃথিবীর কাছে পরিচিতি পাচ্ছে। অনেক গেস্ট হাউস হোটেল তৈরি হচ্ছে। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট এবং বেকারি। এখানকার বিখ্যাত একটি বেকারি Delialah, ভারতীয় রেস্টুরেন্ট আছে। আমার মতে একটি ঠান্ডা বিয়ার নিয়ে নদীর ধারে বসে থাকলেই নং খিয়াও ভ্রমণ সার্থক। তবে হ্যাঁ আপনার যদি অ্যাডভেঞ্চার ভালো লাগে তাহলে দুটো তিনটে জিনিস করতে পারেন।
প্রথমত, এক দিন চলুন পাঠক গুহার রাস্তায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধকালীন লাউ কিছু কম আমেরিকান বোমের উৎপাত সহ্য করেনি। প্রতিবাদী রাজনৈতিক দলগুলি তখন এই গুহার মধ্যে থেকে যুদ্ধ এবং সরকার চালাতেন। পাঠক এরকম একটি গুহা। এর মধ্যে হসপিটাল ব্যাংক স্কুল সমস্ত ছিল। উল্টো দিকে আরেকটি গুহা আছে, যেখানে তিনদিন ধরে আগুন জ্বলেছিল। এ গুহা থেকে আমি কয়েকটি বুলেটের টুকরো কুড়ি এনেছিলাম। এখনো এখানে এন্টি এ ক্রাফট মিসাইল ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়।
দ্বিতীয়তঃ একদিন চলুন হাইকে যাওয়া যাক। নং খিয়াও ভিউ পয়েন্ট পাহাড়ের উপরে একটি অত্যন্ত সুন্দর জায়গা। এখান থেকে পুরো এলাকার 360° একটি ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যদি ভোর বেলায় যান, তাহলে পেঁজা পেঁজা তুলোর মত মেঘ ভেসে আসে পথে, মাঝখান দিয়ে ভেসে চলে নাম ও নদী।
তৃতীয়তঃ এবং প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি এটা আমার সবথেকে সুন্দর পছন্দের অভিজ্ঞতা । কিছু ঘন্টার জন্য একটি নৌকা ভাড়া করে কাছাকাছি আরেকটি গ্রাম ঘুরে আসুন। এই গ্রামটি থেকে আপনি চাইলে বেশ কিছু ট্রেক আর গুহা দেখতে যেতে পারেন। আমার মতে নৌকো বিহার টি যথেষ্ট সুন্দর, বিশেষত যদি আপনার হাতে সময় কম থাকে। যদি আপনি মনে করেন নং খিয়াও এক অথবা দুই সপ্তাহ থাকতে পারবেন, তাহলে অবশ্যই গ্রামে দু-তিনদিন সময় দেবেন।
লুয়াং প্রবাং ঘোরার সময় কিছু কিছু জিনিস মাথায় রাখা ভালো। এ শহরটি খুব রুচিশীল মানুষদের ঘোরার জায়গা। রাত সাড়ে এগারোটার পর ইউনেস্কো নিয়ম অনুযায়ী এখানে সব দোকান বন্ধ হয়ে যায়। নামখান নদীর ধারে কিছু বার খোলা থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু পুরনো শহর অনেক তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যায়। ইন্টারনেট খুব ভালো চলে, তবে এখান থেকে যত ভেতরের দিকে যাবেন তত নেটওয়ার্ক ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে। আপনি যদি মনে করেন রাতে এক ঘন্টা লগইন করে অফিসের কাজ করবেন, তাহলে কিন্তু অসুবিধা।
লাও ভ্রমণের জন্য সুসময় শুকনো মরসুম। এই ধরুন অক্টোবর থেকে মার্চ। যদিও আমি জুলাই মাসে গেছিলাম, আমি ফিরে আসার এক সপ্তাহের মধ্যেই লাও দেশে মারাত্মক একটি বন্যা দুর্ঘটনা ঘটে। অবশ্য নতুন কিছু না, প্রত্যেক বছরে বৃষ্টির সময় মেকং নদী এখানে বন্যা ঘটিয়ে থাকে। বন্যার পলিমাটি লাও কৃষিপ্রধান অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলে।
লাও সম্পর্কিত ইউটিউব ভিডিও দেখুন এইখানে।
Beautiful. Incredible!
Love this decorative Vlog .