গত ডিসেম্বর মাসে দু সপ্তাহের জন্য ঘুরে এলাম দারুচিনির দ্বীপ, শ্রীলংকা। তখন সবে সবে লকডাউন উঠেছে, শ্রীলংকা সরকার এই তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েনি। শীতের রাশিয়া থেকে পরিযায়ী মানুষগুলি ভারতের গোয়াতে তাদের চার্টার প্লেন নামাতে পারেনি, তাই রাস্তা বদল করে চলে এসেছে শ্রীলংকার দক্ষিণ উপকূলে। ইউরোপিয়ান বা আমেরিকানরা কিন্তু তখনও পূর্ব গোলার্ধে আসার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি।
কাজেই যে শ্রীলঙ্কার অপরূপ রূপ আমি দেখেছি, তার কৃতিত্ব বহুলাংশে যায় জনহীন ভ্রমণ স্থান গুলির জন্য।
অনেকেই জিজ্ঞেস করেছিল শ্রীলঙ্কা কেন যাচ্ছো? সত্যি বলতে কি, আমারও ধারণা ছিল পাসপোর্টে একটি অতিরিক্ত দেশের স্টাম্প ছাড়া শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ আমাকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে উঠতে পারবে না।
কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। এই ভারত মহাসাগরের মুক্তাটি শুধু যে অপরূপ প্রকৃতির সাথে আমাকে পরিচয় করিয়েছে তা নয়, তার দিয়েছে কিছু সুন্দর মানুষের বন্ধুত্ব। তা না হলে তো, সমুদ্র দেখার জন্য আমাদের গোয়া আছেই, আর চা বাগান দেখতে হলে দার্জিলিং বা মুন্নার।
আমাদের যাত্রা পথটি এরকম ছিল: কলম্বো- ক্যান্ডি- নুয়ারা এলিয়া- এল্লা- মিরিস্যা – উনায়টুনা – গল্লে – কলম্বো
ব্যাঙ্গালোর থেকে ইন্ডিগো এয়ারলাইন্স ধরে তিন ঘন্টা উড়ে পৌঁছে গেলাম কলম্বো এয়ারপোর্ট।
কলম্বো ফোর্ট এরিয়াতে একটি হোটেলে রাত্রিযাপন করে,
পরের দিন পেটটা ( Pettah) বাজারে গিয়ে খুঁজে খুঁজে বার করলাম ময়ুরা হোটেল, সে আসলে আমাদের স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেলের সিংহলি ভাই।
ঐ হোটেলে যাই খেতে দেয় একটু খুঁজলেই পাওয়া যায় ছোট ছোট মাছ। ডাল বলুন, একটা ঘ্যাট বলুন আর যাই বলুন। তবে হ্যাঁ অমলেট টা শুধু ডিম দিয়ে বানানো ছিল। 😅
কলম্বোতে ইচ্ছে করলে বেশ কিছু বৌদ্ধ মন্দির এবং মূরদের বানানো লাল সাদা মসজিদ দেখে বিকেলবেলাটা কাটাতে পারেন galle face বীচের কাছে। আর তা না হলে বাজার ঘুরে দেখুন, ব্রিটিশদের বানানো প্রচুর পুরনো বাড়ি। আমাদের কলকাতার সাথে অনেক মিল পাবেন।
পরের দিন চলে এলাম কলম্বো থেকে ক্যান্ডি। এখানে উবার চলে না, চলে পিক মি নামে একটি অ্যাপ। হোটেলকে বলেও গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারেন। রাস্তাঘাটে উল্টোপাল্টা জায়গায় হাতি দেখতে চলে যাবেন না যেন। হাতিদের দেশে গিয়ে পায়ের শিকল বাধা হাতি দেখে কি লাভ বলুন? ক্যান্ডিতে যদি তিন থেকে চার দিন কাটান, তাহলে আরামসে শ্রীলঙ্কার সংস্কৃতিক রাজধানী ঘুরে ফেলতে পারবেন। সেখানে আছে অনুরাধাপুরা নগরীর ধ্বংসাবশেষ, বিখ্যাত সিগিরিয়া পাথর, আর ক্যান্ডি শহর যেখানে এখনো ভগবান বুদ্ধের একটি দাঁত সংরক্ষিত আছে।
ভগবান বুদ্ধের দাঁত শ্রীলংকার মানুষজন সব সময় রাজা সিংহাসনের পাশেই রেখেছেন, অন্তত যতদিন পর্যন্ত না শ্রীলঙ্কাকে একটি গণপ্রজাতন্ত্রী দেশ হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। শ্রীলঙ্কার শেষ রাজা রাজত্ব করে গেছেন ক্যান্ডিতে। তাই এখানেই চিরস্থায়ী ভাবে ওই দাঁতটিকে একটি মন্দিরে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। অবশ্যই যাবেন সন্ধ্যেবেলায় যখন স্থানীয় মানুষ দুন্দুভী এবং সানাই বাজিয়ে ওই দাঁতটিকে সর্বসাধারণের পূজার জন্য বাইরে নিয়ে আসে। কথিত আছে চিতা থেকে উদ্ধার করে ওই দাঁতটিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শ্রীলংকাতে। মন্দিরের গায়ে বিভিন্ন রকমের মুরাল আঁকা তাতে দেখানো হয়েছে কিভাবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে আদিকালে পারসিকিউট করা হয়েছিল।
আমি ক্যান্ডিতে একদিন থেকেই চলে এসেছিলাম নুয়ারা এলিয়া। আপনি চাইলে আরো কিছুদিন থেকে সিগিরিয়াতে হাজারটা সিঁড়ি চড়ে লায়েন্স রক হাইক করে আসতে পারেন।
এবার আসি শ্রীলংকার ট্রেন জার্নি র গল্পতে। ব্লগের সূত্রে একজন আমার পরিচয় হয়েছিল শশিকলার সাথে। সে এক সিংহলি মেয়ে, বিয়ে করেছে উত্তর শ্রীলংকার একটি তামিল ছেলেকে যে জীবনের বেশিরভাগটাই কাটিয়েছে তামিলনাড়ুতে পড়াশোনা করার সুবাদে আর কিছুদিন সৌদি আরবে কারণ তার বাবা গাল্ফে চাকরি করতেন। শশীকলা আমাকে ভালোবেসে শ্রীলঙ্কার ট্রেনের টিকেট কেটে দিয়েছিল। আমি চেষ্টা করেছিলাম ভারত থেকে টিকিট কাটার কিন্তু হয়নি। তবে শুনেছি অনেক এজেন্ট আছে যারা আপনাকে সাহায্য করতে পারে। তাছাড়া লকডাউনের পরে ওই দেশে বিভিন্ন রকমের রুল চেঞ্জ হচ্ছে।
আপনি কিন্তু অবশ্যই প্রথম শ্রেণীর টিকিট কাটবেন। দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভিড় অনেক বেশি হয় অনেক সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হয়, ব্যাগ রাখার জায়গা পাওয়া যায় না। হয়তো জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আপনি ছবি তুলতে পারবেন না ট্রেন থেকে। সে আমার মনে হয় না ভারতীয়দের শ্রীলঙ্কা গিয়ে ট্রেনে ছবি তোলার দরকার আছে।
আমরা যে ট্রেনটিতে চড়েছিলাম সেটি জন্মসূত্রে চীনা। ছোট্ট একটি ট্রেন, পরিষ্কার এবং নতুন, একদম ভ্রমণ পিপাসুদের জন্যই বানানো। আসলে কিন্তু শ্রীলংকার রেললাইন বানিয়েছিল ব্রিটিশরা। এই ব্রিটিশগুলি সব জায়গাতে গিয়ে চা বাগান করে আর ট্রেন বানায় আমি মরিশাসে ও দেখেছি। উদ্দেশ্য আর কিছু না ট্রেনে করে চা-পাতা গুলিকে কলম্বো জাহাজ বন্দরে আনা, তারপর সেখান থেকে পশ্চিমা দেশগুলিতে জমিয়ে ব্যবসা। ডিলমা, লিপটন, এ ধরনের বিখ্যাত নাম আমরা বাঙালিরা শুনেই বড় হয়েছি এগুলি সব শ্রীলংকার চা। তবে সত্যি কথা বলতে কি আমার তেমন ভালো লাগেনি, মানে আমাদের দার্জিলিংয়ের গোল্ডেন টিপস এর ধারে কাছে নয়।
তবে হ্যাঁ শ্রীলংকা গিয়ে একটা জিনিস না কিনে ফিরবেন না সেটি হল কাঠের তৈরি মুখোশ। খুব উজ্জ্বল রং দিয়ে তৈরি এমন একটি মুখোশ আমি কিনেছিলাম, তারপর সে ব্যাঙ্গালোর হয়ে কলকাতা হয়ে আপাতত আমায় নিউইয়র্কে বাড়িতে শোভা পাচ্ছে। আই লাভ ইট। লাকসালা ওয়ার্কশপ যেটি শ্রীলঙ্কা গভরমেন্ট দ্বারা পরিচালিত সেখানে গিয়ে আপনি এটা কিনতে পারেন আর না হলে যে কোন সমুদ্র উপকূলবর্তী শহরে পেয়ে যাবেন ভারতীয় মুদ্রায় ৫০০ কাছাকাছি দাম হয়, যত বড় রূপ নেবেন তত দাম বেশি।
নুয়ারা এলিয়ার আরেকটি নাম হল প্রথম আলো। স্থানীয় মানুষদের খুব প্রিয় একটি জায়গা। বলা হয় এখানকার হাকগালা উদ্যানটি আসলে রামায়ণের অশোক বন। প্রায় ১৩০০ টাকা ভারতীয় মুদ্রা দিয়ে আমরা এই বাগানে ঢুকে একদম উপর অব্দি চড়েছিলাম। সত্যিই যদি এই জায়গাটি অশোকবন হয়ে থাকে খুব একটা আশ্চর্য হব না। পাশে একটি সীতামাতা মন্দিরও আছে, খুব পুরনো কিছু কালো পাথরের ঠাকুরের মূর্তি রাখা। স্থানীয় মানুষদের কাছে নুয়ারা এলিয়া একটি ছোট ইউরোপিয়ান শহরের শ্রীলঙ্কান প্রতিমূর্তি। ব্রিটিশ রাই চা চাষ করার পর কলম্বোর অসহ্য গরমে অতিষ্ঠ হয়ে নুয়ারা এরিয়ার পাহাড়ে উঠে একটি ছোট শহর তৈরি করেছিল। গলফ কোর্স, চাবাগান, ডেয়ারী ফার্ম, এই নিয়ে এখনো রয়েছে নুয়ারা এলিয়া।
আমরা দুদিন কাটিয়েছিলাম এইখানে। আপনি চাইলে সরাসরি এলা চলে যেতে পারেন। বলা হয় একটি সুন্দর রোদ ঝলমলে দিনে এলার আদম পাহাড় থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে কলম্বো আরামসে দেখা যায়। তবে হ্যাঁ আমার এলা অসাধারণ লেগেছিল যদিও আমি কোনো রকম পাহাড় চড়ার কসরত করতে যায়নি। তার একটা বড় কারণ এলাতে আমরা একটি হোটেলে ছিলাম তার নাম দা ভিউ। মোটামুটি কুড়ি কেজি ব্যাগ টেনে টেনে আমাদের ভিউ অব্দি হেঁটে চড়তে হয়েছিল যেটা একপ্রকার হাইক ই বলা যেতে পারে। চা বাগানের মধ্য দিয়ে দু কিলোমিটার হাটা। এলার নাইট লাইফ বেশ ভালো। এখান থেকে রাত্রিবেলাতে আপনারা অ্যাস্ট্রো ফটোগ্রাফিও করতে পারেন। আকাশ একদম পরিষ্কার থাকে। মনোরম আবহাওয়া। একটা হালকা চাদর দিয়ে রাখবেন এলাতে। আর এখানে এসে স্টীক নো বিল নামে একটি দোকানে গিয়ে ফ্রিজ ম্যাগনেট কিনতে ভুলবেন না কিন্তু।
এলা ক্রস করে আপনি একটা দিন চলে যেতে পারেন ইয়ালা ন্যাশনাল পার্ক যেখানে প্রচুর লেপার্ড দেখতে পাওয়া যায় আর হাতি তো বটেই। আর না হলে উদাওয়ালা পার্ক ও দেখতে পারেন, যেখানে বন্য ছোট হাতি গুলিকে ট্রানজিট ক্যাম্পে আনা হয়। এরা হয়তো শিকারীর হাতে বাবা মাকে হারিয়েছে বা দল থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। চেষ্টা করা হয় এদেরকে আবার জঙ্গলে ফিরিয়ে দেওয়ার। সব থেকে এথিক্যাল ভাবে এখানেই হাতি দেখা যায়।
আমরা অবশ্য একটা গাড়ি ভাড়া করে প্রায় চার হাজার টাকা ভারতীয় মুদ্রায় পাঁচ ঘন্টা ট্রাভেল করে সোজা
চলে এসেছিলাম মিরিস্যা বিচ। এখানেই আমরা নতুন বছরকে আপ্যায়ন করেছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি মিরিস্যা বীচ আমার অসাধারণ লেগেছে। তখনো সমস্ত জায়গা ভালোভাবে খোলেনি তবে আপনি যদি আর কোথাও না গিয়ে শুধু মিরিসা বিচে দু তিনটে দিন কাটাতে চান আরামসে করতে পারবেন। গোয়ার মতনই এখানে স্কুটি ভাড়া পাওয়া যায়। আর পেট্রোল তো আমি দেখেছি বোতলেও বিক্রি করে মুদির দোকান মত জায়গাতে। সে নিয়ে আশেপাশে মেগম্ব মা তারা লাইট হাউস বিভিন্ন জায়গা ঘুরে আসতে পারেন। একদিন পুরোটা কাটাবেন সিক্রেট বীচ নামে একটি জায়গাতে। সেও একটি ছোট পাহাড় পেরিয়ে নামতে হয়। পাহাড়ের গায়ে একটি ছোট্ট গ্রাম। পাঁচটি ঘরের বেশি জায়গা নেই। কি অসাধারণ প্রকৃতির শোভা এখানে।
সিক্রেট বিচে একটি খাওয়ার জায়গা আছে। যেখানে তাজা মাছ ভেজে দেয় আর বিয়ার পাওয়া যায়।
একদিন যদি একটু ভালো ডিনার করতে চান তাহলে অবশ্যই চলে যাবেন ডাচম্যান স্ট্রিট নামে রেস্টুরেন্টে।
ঐ বিচে আমরা চারদিন কাটিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম উন্নায়াটুনা নামে একটি বিচের দিকে। এইখানে আড়ালিয়া রিসোর্ট অত্যন্ত সুন্দর থাকা জায়গা। যদি চান তাহলে কিছু হলিডে হোম টাইপের বাড়ি ও ভাড়া নিতে পারেন। মিরিস্যা্র থেকে এইটি ছোট, কিন্তু এখানে অনেক বেশি টুরিস্ট অ্যাক্টিভিটি করা যায়। অবশ্যই যাবেন এখান থেকে গলে ফোর্ট দেখতে। প্রচুর পুরনো ডাচ বাড়িঘর কনভার্ট করে এখন মিউজিয়াম বা হোটেল বানানো হয়েছে। রয়েছে প্রচুর সুন্দর দোকান। পুরনো কিছু গির্জা একটি মসজিদ। এখান থেকে আমরা ফিরে এসেছিলাম কলম্বো।
শেষের দিনটা রেখেছিলাম বিখ্যাত মিনিস্ট্রি অফ ক্র্যাবে গিয়ে কাকড়া খাওয়ার জন্য। সত্যি কথা বলতে কি, দাম অত্যন্ত বেশি কিন্তু এত ভালো কাঁকড়া এর আগে বা পরে অন্য কোথাও খাইনি।। আমি বলব শপিং না করে বা অন্য কিছু জায়গায় বাজেট কাটছাঁট করে, একবার ঢুকেই দেখুন। আমি তো সাত মাস পরেও সেই সন্ধ্যেটা ভুলে উঠতে পারিনি।
শ্রীলঙ্কায় অনেক বেশি লাক্সারি এক্সপেরিয়েন্স হবে না। ব্যাকপ্যাকিং এবং বাজেট ট্রাভেলিংয়ের জন্য একদম আদর্শ জায়গা। তেলের দাম বাড়ার সাথে সাথে সব কিছুরই দাম একটু ঊর্ধ্বগামী। কিন্তু তাও যদি আপনি ট্রেনে যাতায়াত করেন আর হোস্টেলে থাকেন, তাহলে দু সপ্তাহ শ্রীলংকা ঘুরতে আপনার 30 থেকে 40 হাজার ভারতীয় মুদ্রা খরচা হবে। যদি একটু স্বাচ্ছন্দ আশা করেন, এক লাখের মধ্যে শ্রীলংকা খুব সুন্দরভাবে হয়ে যাবে দুজনের জন্য। হাতে অন্তত দশটা দিন সময় রাখবেন না হলে কিন্তু শুধু সমুদ্র ঘুরেই চলে আসতে হবে।