আগের সপ্তাহে ঘুরে এলাম পশ্চিমঘাট পর্বতমালার ভা৺জে অবস্থিত চিকমাগালুর। দীর্ঘ তিন মাস পর বেঙ্গালুরু তথা কর্ণাটক ধীরে ধীরে আনলক হচ্ছে। এখনো রাজ্য অতিক্রম করে ঘুরতে যাওয়ার অনেক হ্যাপা। কর্নাটকের বেশ কিছু অঞ্চল এখনো দৃঢ়ভাবে নজরে রাখা হয়েছে, যেমন কুরগ বা মাদিকেরি।
তবে মৌসুমী বায়ুর আগমনের সাথে সাথে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা এক অপরূপ রূপ ধারণ করে। সেই দৃশ্য দাপটের সাথে পাল্লা দিতে পারে হিমালয়ের দুর্গম পাস গুলির সাথে। বর্ষাকালের সেই মনমোহনী রূপ চাক্ষুষ করব আর সেই সাথে কিছুদিন শহর থেকে দূরে থাকবো এই আশা নিয়ে আমরা চারজন প্রাপ্তবয়স্ক আর একটি খুদে মানুষ বেরিয়ে পড়েছিলাম এক ভোর বেলায়। সাথে একটি ইনোভা গাড়ি, সভারী রেন্টাল থেকে ভাড়া নেওয়া। চার দিনের জন্য আমরা দিয়েছিলাম 15000 টাকা।
আমাদের গন্তব্য ছিল আদ্রিকা হোটেল। চিকমাগালুর একটি ছোট টাউন, কাছাকাছির মধ্যে বড় শহরগুলোতে হাসান। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, বাঙালোরে যত বড় বড় রুই কাতলা পাওয়া যায় সব কিন্তু আসে হাসান নদী বাঁধের থেকে।
চিকমাগালুর টাউনে দুটি রাস্তা। একটি সাধারণত one way হয়ে থাকে। রাস্তার ধারে সারি সারি দোকান, সিল্ক শাড়ি, কফি, ফিল্টার কফি মেশিন, দোসা ক্যান্টিন, আর দু-চারটি নতুন ধরনের ক্যাফে এই নিয়েই টাউন টি তৈরি। দেখেই বোঝা যায়, বেশকিছুদিন টুরিস্ট না আসার জন্য দোকান গুলি ধুঁকছে। আদ্রিকা হোটেলের পাশে ব্যাঙ্গালোর থেকে আসা লাল রঙের সরকারি স্টেট বাস গুলি দাঁড়িয়ে থাকে। তবে হোটেল থেকে ভিউ বলতে সেরকম কিছু নেই। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হোটেল, বেশ বড় রুম, ইন্টারনেট খারাপ নয়, আর প্রধান সুবিধা হল বাজার একদম হাতের কাছে।
ইচ্ছে করলে আপনি টাউন পেরিয়ে চলে যেতে পারেন পাহাড়ের ভেতরে অবস্থিত বেশকিছু বিলাসবহুল রিসোর্ট অথবা সুন্দর করে সাজানো হোমস্টে গুলিতে। অসুবিধা একটাই, বাজার অনেক দূর। তো রোজ আপনাকে ওই রিসোর্টের একই ধরনের খাওয়া খেতে হবে। অবশ্যই জনপদ থেকে দূর অবস্থান জনিত কারণে, খরচা অনেক বেশি।
একদিন আমরা গাড়ি নিয়ে চলে গেছিলাম মূল্যয়নগিরি শৃঙ্গ তে। বলা হয় এটি কর্নাটকের সবথেকে উচু পাহাড়। পথে একটি চেক পয়েন্ট পড়ে যেখানে RAT কোভিদ টেস্ট হচ্ছে। তবে আপনাদের যদি দুটি ভ্যাকসিন হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে আটকাবে না। পাহাড়ের নিচের দিকে ভর্তি কফি বাগান। সুন্দর রাস্তা দিয়ে কিছুদুর ওঠার পরে অনেকগুলি ঝরনা দেখতে পাবেন। দক্ষিণ ভারতে বর্ষাকালীন পাহাড়ি ঝরনা গুলিতে চান করা যাকে বলে is a thing.
মেঘ ঝরনা কফি বাগান মন্দির এই সমস্ত পেরিয়ে আপনি যখন পাহাড়ের চূড়ার কাছাকাছি একবার গাড়ি দাঁড় করিয়ে নিন। একটুখানি নেমে দেখুন সুদূর উপত্যকা, বিঘার পর বিঘা জমি ঘনসবুজ জঙ্গলের ঢাকা। যদি ভাগ্যবান হন এই জঙ্গলে দেখা হয়ে যেতে পারে বাঘ বা হাতির সাথে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, কর্নাটকে কিন্তু সবথেকে বেশি বাঘ থাকে পুরো ভারতবর্ষের মধ্যে। হ্যাঁ মানে আমাদের রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
মূল্যয়ন গিরি চূড়ার কাছাকাছি গিয়ে আমার মনে পড়ে যায় হিমাচলের কসোলের কথা। বেশকিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, লারেলাপ্পা গান চলছে, মেঘ আর কুয়াশার জন্য 2 মিটার দূরে কি আছে আপনি দেখতে পাবেন না। শুধু শুনতে পাবেন অজস্র সিটির অত্যুৎসাহী শব্দ। 5 মিনিট থেকে আমরা নেমে এলাম বাবাবুদান গিরি র দিকে।
এই পাহাড়ের চূড়া তে একজন সুফি সাধকের কবর রয়েছে। বহু মানুষ এখানে আসেন মানত পূরণ করতে, ধর্ম নির্বিশেষে। তবে আমাদের কপাল খারাপ। রাস্তায় শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। আমরা ফিরে আসতে বাধ্য হলাম। তবে সেই অসাধারণ দৃশ্য কিছুটা হলেও আমি ভিডিও ক্যামেরা তে ক্যাপচার করেছি।
পরের দিন সন্ধ্যেবেলায় আমরা গিয়েছিলাম হিরেকোলালে লেক। কফি বাগান এর মধ্য দিয়ে বেশকিছু হোমস্টে পেরিয়ে আপনি এসে পৌঁছাবেন এই জলাশয়। সূর্যাস্ত ভালো সময় এখানে আসার, তবে বর্ষাকালে আর কি সূর্যাস্ত আর কি দুপুরবেলা।
ফেরত আসার সময় আমরা দাঁড়ালাম টাউন ক্যান্টিন নামে একটি পুরনো ক্যাফেতে। এখানকার বেনে ধোসা কর্নাটকের বিখ্যাত। ধোসা তৈরি হয় বিশুদ্ধ মাখন ব্যবহার করে। চাইলে, এক টুকরো বাটার ওপরেও দিয়ে দেয়। মানে সে কি আর বলব, মাখনে মাখামাখি কান্ড।
এইবেলা বলে রাখি বাবাবুদাঙ্গীরি পাহাড়ের কফি কিন্তু জগদ্বিখ্যাত। চিকমাগালুর এসে কফি না কিনে আপনি ফেরত যেতে পারবেন না। উচিত ও না।
টাউন ক্যান্টিনে, লাঞ্চ শেষ করে, চলে আসুন পান্ডুরাঙ্গা কফি দোকানে। সুসময়ে আপনি এদের কফি বাগানেও যেতে পারেন। তবে এখন নিরাপত্তাজনিত কারণে কফি বাগানে সেইভাবে টুরিস্ট ঢুকতে দিচ্ছেনা। আমি অবশ্য ঢুকে গেছিলাম একটি নির্জন কফি এস্টেটে। কফি ফলগুলি এই সময় সবুজ হয়ে আছে। কাঁচা থেকে পাকা অবস্থার মধ্যে এগুলি লাল হবে, তারপর রোদে শুকিয়ে রোস্ট করা হবে, তারপর সব থেকে ভালো কফি বীজগুলি চলে যাবে বিদেশে।
এখানে জয়ন্তী কাছেও যথেষ্ট ফেমাস। সেখানে তো সেখানে উড়ে কফি উৎপাদন এর ইতিহাস বড় করে আঁকা আছে দেওয়ালে। তবে জয়ন্তী ক্যাফের সার্ভিস অত্যন্ত ধীর গতি।
এছাড়াও মহারাজা রেস্টুরেন্টের মাটন দম বিরিয়ানী ট্রাই করতে ভুলবেন না। টাউন টেবিল রেস্টুরেন্ট থেকে সুইগী করে নিতে পারেন মাটন চটপটা। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের এরাবিক রেস্টুরেন্ট তো আছেই। আমরা রাতের খাবারটা সাধারণত ঘরে এনে খেতাম। ন’টার পরে চিকমাগালুর সবকিছু বন্ধ হয়ে যেত।
চিকমাগালুরে সাধারণত দুই ধরণের মানুষ গিয়ে থাকেন। একদল অত্যন্ত ল্যাদখোর, যেমন আমরা। দিনে দু ঘন্টা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে একটু ঘোরাঘুরি করে কতক্ষণে হোটেল রুমে ফিরে আসা যায়। আর এক দল যারা ট্রেকিং করতে পছন্দ করেন। পছন্দ করেন পাহাড়ের ধারে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত দিবসে প্রকৃতিকে দুচোখ ভরে উপভোগ করতে। দু’দলই যেতে পারেন আরামসে। তবে হ্যাঁ, মুখোশ করতে ভুলবেন না। লোকজনের ভিড় এখনো এখানে মারাত্মক হয়ে ওঠেনি। Social distancing is not a problem in Chikmagalur.